১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

 

জাতি  হারালো অভিজ্ঞ বরেন্য এক রাজনীতিবিদকে  

আপডেট: মে ২৯, ২০২০

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন

জাতি  হারালো  এক অভিজ্ঞ  বরেন্য রাজনীতিবিদ  সূর্যসন্তানকে

…….মুহাম্মদ মাসুম খান  
♦ ৬ মে রোজ বুধ বার সকাল সারে নয়টায় স্কয়ার হাসপাতালে হৃদ রোগজনিত  অসুস্থতায়  ৮০ বছর বয়সে  শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ঢাকা-৫ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা  আলহাজ্ব হাবিবুর রহমান মোল্লা।তিনি সমসাময়িক নেতাদের মধ্যে অন্যতম বয়োজৈষ্ঠ নেতা যিনি ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তান শাসন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছেন।  তিনি ঢাকার ডেমরা-যাত্রাবাড়ি আসনে ৪ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তিনি ছিলেন অত্র এলাকার মানুষের দল মত নির্বিশেষে সর্বজন শ্রদ্ধেও  মাটি ও মানুষের নেতা। ১৯৪০ সালে সাবেক তেজগাঁও থানার  মাতুয়াইল এলাকায় এক সম্ভান্ত ঐতিহ্যবাহী  মোল্লা  পরিবারে তার জন্ম হয়। ছোট বেলা থেকেই তিনি  জীবন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন সংসারের বড় ছেলে হওয়ার সুবাধে। শিক্ষার আলো থেকে দুরে থাকা তৎকালীন  অনুন্নত মাতুয়াইল এলাকায় যে কজন তরুন লেখাপড়া করেছেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। মাতুয়াইল থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দুরে বাওয়ানী স্কুলে যেয়ে দূর্গম পথ পেরিয়ে তাকে স্কুলে পড়াশুনা করতে যেতে হয়েছে। সেই যুগে কৃতিত্বের সাথে ২য় বিভাগে মেট্রিক পাশ করে তিনি তেজগাঁও কলেজে পড়াশুনা করেন। ছাত্র অবস্থা থেকেই তিনি সামাজিক এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নিয়মিত অংশগ্রহন করতেন। ব্রিটিশরা যখন ১৯৪৭ সালে এদেশ ছেড়ে চলে যায় তখন তিনি ছিলেন ৭ বছরের বালক। অত্যন্ত প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন হাবিবুর রহমান মোল্লা সেই শৈশবের স্মৃতি প্রায়শই বলতে জনতার মাঝে। পাকিস্তানামলে ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময় ১২ বছর বয়সে তিনি বড় ভাইদের সাথে  রাস্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে শ্লোগান  দিয়েছেন। ষাটের দশকে হাবিবুর রহমান মোল্লা প্রথমে ছাত্র লীগ, পরবর্তিতে শ্রমিক লীগের রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ঠ হন। অত্যন্ত সুদর্শন,সদালাপী এবং পরিশ্রমী হওয়ার কারনে তিনি দ্রুত রাজনীতিতে সফলতা এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ৬২এর আয়ুব খানের স্বৈরাচার   বিরোধি আন্দোলনে বৃহত্তর ঢাকার অন্যতম তরুন উদীয়মান নেতা ছিলেন হাবিবুর রহমান মোল্লা। ৬০ এর দশকেই তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পান। ৬৬ এর ছয় দফা, ৬৯ এর গন আন্দোলন, ৭০ এর নির্বাচনে হাবিবুর রহমান মোল্লা ছিলেন রাজপথ কাঁপানো বঙ্গবন্ধুর পরীক্ষীত সৈনিক।বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে  তিনি  তৎকালিন তেজগাঁও থানার ডেমরা,মাতুয়াইল  এলাকায় নৌকা বেয়ে বেয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে। হাবিবুর রহমান মোল্লা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত প্রিয় এবং আস্থাভাজন তরুন উদীয়মান পরীক্ষীত, ত্যাগী নেতা। ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের সোহরাওয়ার্দী  উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ভাষনের দিন হাবিবুর রহমান মোল্লার নেতৃত্বেই ডেমরা-মাতুয়াইল – যাত্রাবাড়ি এলাকার মানুষ  দলে দলে সেখানে গিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হাবিবুর রহমান ৩১ বছর বয়সে ছোট ছোট  ছেলে -মেয়ে এবং স্ত্রী সংসারের মায়া ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর  আরো ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেন এবং দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।৭৫ এ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যা হওয়ার  পরবর্তিতে তিনি  মোশতাক সরকারের সময় বিভিন্ন হয়রানী ও জেল জুলুমের শিকার হয়েছেন। কিন্তু শত নির্যাতনের মাঝেও তিনি এক মুহুর্তের জন্যেও   আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন নি। পরবর্তিতে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে দলের  হাল ধরলে হাবিবুর রহমান মোল্লা দলকে সংগঠিত করার করার কাজে মনোনিবেশ করেন। নব্বইয়ের এরশাদ বিরোধি গন আন্দোলনেও মোল্লা বৃহত্তর ডেমরা থানার নেতৃত্ব দিয়েছেন বলিষ্টভাবে। বিশেষকরে ডেমরা পাট এবং শিল্পের জন্য বিখ্যাত হওয়ায় শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকা হওয়াতে  তৎকালীন সময়ে পুরু ঢাকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করতো ডেমরা এলাকা। স্বৈরাচার বিরোধি আন্দোলন করতে যেয়ে তিনি অনেক বার জেল খেটেছেন। অবশেষে ৯০ এর গন আন্দোলনে এরশাদের পতন হলে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। কিন্তু সে বছর সামান্য ভোটের ব্যবধানে নির্বাচনে পরাজিত হন।পরবর্তিতে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি জেলে থাকা অবস্থাতেও বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তিতে তিনি ২০০৯,২০১৫ এবং ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের  প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন জননেত্রি শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন যার থেকে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর ঘ্রান পেতেন।তার  দীর্ঘ বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনোই সহিংস এবং সন্ত্রাসি রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেননি।তিনি ছিলেন শান্তিপ্রিয়  এবং শিক্ষা বান্ধব রাজনীতির অগ্রদূত।  তিনি কখনোই মানুষকে শুধুই  রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে  গন্য করেন নি,মূল্যায়ন করেন নি। ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মিরাও তার থেকে সকল ধরনের সহযোগিতা পেয়েছেন।বিশেষকরে ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের বহু শিক্ষক তার উদারতার সুযোগে  তার মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন, সুবিধা নিয়েছেন। তিনি ছিলেন ডেমরা-যাত্রাবাড়ি  এলাকার সকল রাজনীতিক নেতা কর্মিদের আশ্রয় ও ভরসার পাত্র। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সদালাপী, মিষ্ঠভাষী,সামাজিক,ধার্মিক,আসাম্প্রদায়িক, শিক্ষানুরাগী এবং মানবিক গুন সম্পন্ন এক   মহান নেতা। এই  অবিসংবাদিত বরেন্য নেতার মৃত্যুতে  সর্বস্তরের নেতা,কর্মি এলাকাবাসী অত্যন্ত শোকাহত এবং মর্মাহত। মৃত্যুর সময় এই মহান নেতা তিন পুত্র, দুই কন্যাসহ  অসংখ্য আত্মীয় স্বজন, বন্ধু, ভক্ত এবং শুভাকাংখি রেখে গিয়েছেন। আলহাজ্ব হাবিবুর রহমান মোল্লার শুন্যতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির  জন্য এক  অপূরনীয় ক্ষতি।
 তার মৃত্যুতে বৃহত্তর ডেমরা-যাত্রাবাড়ির মানুষ  হারালো এক অকৃত্রিম রাজনৈতিক অভিভাবকে, জাতি হারালো বঙ্গবন্ধুর  একান্ত আস্থাভাজন একজন সংগ্রামী  সহযোদ্ধাকে। বিদেহী আত্মাকে মহান আল্লাহ তায়ালা  মাগফেরাত দান করুন এবং  শোক সন্তপ্ত পরিবারকে  শোক সহ্য করার শক্তি দান করুন।আমীন।
লেখক : মুহাম্মদ মাসুম খান, সহ সভাপতি, ৭১এর চেতনা মঞ্চ,
কেন্দ্রিয় কার্যনির্বাহি  সদস্য,স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ।
সাংগঠনিক সম্পাদক,বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষনা পরিষদ,নাঃগঞ্জ জেলা।
সহকারি প্রধান শিক্ষক, ডগাইর রুস্তম আলী উচ্চ বিদ্যালয়,
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন
Website Design and Developed By Engineer BD Network