২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার

 

হেফাজতে ইসলামের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল || তাণ্ডব, নিহত দুই

আপডেট: মার্চ ২৯, ২০২১

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন

নেক্সটনিউজ প্রতিবেদক :  শান্তিপূর্ণভাবে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালনের প্রতিশ্রুতি দিলেও সারাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। এতে  দুইজন নিহত হন।

রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও রাজধানীর ডেমরা-মাতুয়াইলের সাইনবোর্ডসহ দেশের বিভিন্ন স্থান রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বেশ কয়েকটি স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হরতালকারীদের সংঘর্ষ হয়।

কয়েকটি স্থানে ট্রেনে হামলা চালানো হয়। রেলপথের নাট-বল্টু খুলে নেওয়ার পাশাপাশি রেললাইনে কংক্রিটের স্লাব ফেলে রাখা হয়।

 

দিনের একপর্যায়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-নোয়াখালী ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কয়েকটি স্থানে ট্রেন আটকাও পড়ে। পিকেটাররা বেশকিছু এলাকায় যানবাহনে আগুন দেয়।

মোটরসাইকেলসহ নানা ধরনের যানবাহন ভাঙচুর করে। তবে কয়েকটি জায়গা ছাড়া অধিকাংশ স্থানে পুলিশ সহনশীল আচরণ করেছে।

কিশোরগঞ্জে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে হরতাল সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষকালে ওসিসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।

নারায়ণগঞ্জে দিনভর সংঘর্ষে ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সন্ধ্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফিল্মি কায়দায় সাতটি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়।

সিলেটে ছাত্রলীগ ও হেফাজত কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে পাঁচজন আহত হয়েছেন। হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে ওসির গাড়ি এবং দুটি মোটরসাইকেল ভাংচুর ও আগুন দেয় হরতাল সমর্থকরা।

এ সময় পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন। হরতালকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে দোকানপাটসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল।

খুলনাসহ অনেক স্থানে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়াসহ অনেক স্থানে হরতালের তেমন প্রভাব পড়েনি। দেশের বিভিন্ন স্থানে হরতালের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ শোডাউন করেছে।

এদিকে দাবিদাওয়া মানা না হলে কঠিন কর্মসূচি দেওয়ার হুংকার দিয়েছেন হেফজাত আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। এদিকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে হেফাজতে ইসলাম। সোমবার দেশব্যাপী দোয়া মাহফিল এবং আগামী শুক্রবার বিক্ষোভ মিছিল করবে সংগঠনটি।

ঢাকায় হরতাল চলাকালে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা টায়ার জ্বালিয়ে, বৈদ্যুতিক খুঁটি ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা অবরোধ করেছে। বিভিন্ন অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে।

পুলিশের ওপর হামলাও চালায়। হামলায় দুজন ওসিসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ আহত হয়েছেন। তবে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকা এবং দেশের বেশির ভাগ স্থানে হরতালের খুব একটা প্রভাব পড়েনি।

ঢিলেঢালাভাবে হরতাল পালিত হয়েছে। রাস্তায় গণপরিবহণের সংখ্যা অন্য দিনগুলোর চেয়ে কম ছিল।

রাজধানীর পল্টনে হরতালের সমর্থনে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল, সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটে। মোহাম্মদপুরে সড়ক অবরোধ করেন হরতাল সমর্থকরা। রাজধানীজুড়ে মোড়ে মোড়ে সতর্ক অবস্থানে ছিল পুলিশ।

সাতমসজিদ রোড, এলিফ্যান্ট রোড, শাহবাগ এবং প্রেস ক্লাব এলাকায় সীমিত সংখ্যক বাস চলতে দেখা গেছে।

বেলা ৩টার পর প্রগতি সরণিতে রাস্তার উভয় পাশে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন হেফাজত সমর্থকরা। এ সময় সেখানে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে বিকাল ৪টার দিকে যানচলাচল আবার শুরু হয়। সকাল-সন্ধ্যা হরতালের মাঝেও রাজধানী থেকে বিভিন্ন রুটে সীমিত সংখ্যক দূরপাল্লার গণপরিবহণ ছেড়ে গেছে।

তবে যাত্রী সংখ্যা কম। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, হরতালে দূরপাল্লার বাস চলেছে। যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল। কয়েকটি জায়গায় বাস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

বায়তুল মোকাররম এলাকায় সক্রিয় ছিলেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। দফায় দফায় মিছিল, সমাবেশ ও সড়ক অবরোধ করেছেন তারা। এ সময় সাময়িক উত্তেজনা তৈরি হলেও অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি।

দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে লাঠি হাতে পল্টন মোড়ে হরতালের পক্ষে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা।

প্রায় ১৫ মিনিট অবস্থানের পর তারা সেখান থেকে আবারও বায়তুল মোকাররমের দিকে মিছিল নিয়ে চলে যান। এ সময় তারা হরতালের পক্ষে স্লোগান দেন। এদিকে সকাল থেকে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট এলাকায় অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

ফলে হেফাজতের মিছিল শুরু হলে উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। পালটাপালটি অবস্থান ঘিরে দুই পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটে। পরবর্তী সময়ে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

রাজধানীর কুড়িলের বসুন্ধরা গেট এলাকায় বসুন্ধরার বড় মাদ্রাসার ছাত্ররা বিক্ষোভ করেন। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে মিছিল নিয়ে সড়কে আসেন তারা। আধা ঘণ্টা অবস্থান নিয়ে রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়। পরে মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা হারুন বোখারির মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তারা অবস্থান কর্মসূচি শেষ করেন।

ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, তেজগাঁও, মগবাজার, হাতিরঝিল, রামপুরা এলাকায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে হরতালের প্রভাব ছিল এসব এলাকায়। স্বাভাবিক দিনের চেয়ে সড়কে যানবাহনের উপস্থিতি ছিল কম। এসব এলাকার কোথাও হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের রাস্তায় নামতে দেখা যায়নি।

রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রহরা। উত্তরায় পিকেটিং বা অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। এদিকে হেফাজতের হরতালকে অবৈধ উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মী মোটরসাইকেল মহড়া এবং সমাবেশ করে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আজমপুরে ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য হাবিব হাসানের নেতৃত্বে হরতালবিরোধী সমাবেশ হয়েছে।

পুরান ঢাকার অন্যতম পাইকারি বাজার মৌলভীবাজার, চকবাজার, ইসলামপুর, বাদামতলী, ইমামগঞ্জ, নয়াবাজার ও মিটফোর্ডের পাইকারি মার্কেটগুলো খোলা ছিল। তবে অন্যদিনের তুলনায় ক্রেতাসমাগম কিছুটা কম হয়েছে। সকালে হাজারীবাগ এলাকায় হেফাজতের নেতাকর্মীরা মিছিল বের করেন। তবে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

এছাড়া লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, কোতোয়ালি ও সূত্রাপুর এলাকায় মিছিল বা পিকেটিং হয়নি। পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক ও আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে মিরপুর, আশুলিয়া, সাভার ও গাজীপুরগামী বাসগুলো নিয়মিত চলাচল করে। এছাড়া গুলিস্তান ও নয়াবাজার থেকে মাওয়া, নবাবগঞ্জ ও আব্দুল্লাহপুরগামী ছোট-বড় যাত্রীবাহী বাস ও লেগুনা চলাচল করে।

জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকা অনেকটাই শান্ত ছিল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রেস ক্লাবের সামনের সড়কে হরতালবিরোধী মিছিল-সমাবেশ করেছে কয়েকটি সংগঠন।

এ সময় সড়কে যান চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে অন্য সময়ের চেয়ে যান চলাচল ছিল অনেক কম।

হরতালের খবর সম্পর্কে যুগান্তরের ব্যুরো অফিস ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য :

ব্রাহ্মণবাড়িয়া : হরতাল সমর্থকরা বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কে অবস্থান নেয় এবং সরকারি দপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।

শহরের পৈরতলা, পুলিশ লাইন্স এলাকা, কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক, বিশ্বরোড এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। এতে দুজন নিহত এবং পুলিশসহ দেড় শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। নিহতরা হলেন-আলামিন (২০) ও আশিক (৩৫)।

হরতাল চলাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা, শিল্পকলা একাডেমি, জেলা পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, ভূমি অফিস, আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন, জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব, আনন্দময়ী কালীবাড়ি মন্দির, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বাড়ি, শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর, উন্নয়ন মেলাসহ বিভিন্ন সরকারি ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। অগ্নিসংযোগও করা হয়।

এ সময় প্রেস ক্লাবের সভাপতি রিয়াজউদ্দিন জামি হামলায় গুরুতর আহত হন। ঢাকা-সিলেট, কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অংশের কমপক্ষে ৪০টি স্পটে টায়ার জ্বালিয়ে সড়কে ব্যারিকেড দেওয়া হয়।

এছাড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে বৈদ্যুতিক খুঁটি ফেলে এবং টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়।

আশুগঞ্জ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) : আশুগঞ্জে দিনব্যাপী বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। দফায় দফায় সংঘর্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন।

ইমাম ওলামা পরিষদের নেতৃত্বে আশুগঞ্জ গোলচত্বর থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের খাটিহাতা বিশ্বরোড পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে টায়ারে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ করা হয়।

শহরের কাচারিবিথীকায় বঙ্গবন্ধুর মুরাল এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর আশুগঞ্জ টোল প্লাজা ভাংচুর করা হয়। আশুগঞ্জ টোল প্লাজায় তিনটি টোলবক্স ভাঙচুর এবং পুলিশ বক্সে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধুর মুরাল ভাংচুরের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিক উপজেলা আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ মিছিল বের করে। এ সময় হেফাজতের সঙ্গে সংঘর্ষে উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক তানভির আযহারসহ ২০ জন আহত হন।

বেলা ১১টার দিকে হেফাজতের কর্মীরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের স্বাধীনতা এবং মহান ভাষা আন্দোলনের শুভেচ্ছা জানানোর সবগুলো গেট ভেঙে আগুন ধরিয়ে দেয়।

এদিকে হরতালকারীরা সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের সাতটি বগির জানালার কাচ ভেঙে ফেলেছে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সোনার বাংলা এক্সপ্রেস আশুগঞ্জের তালশহর স্টেশন অতিক্রম করার সময় হরতালকারীদের হামলার শিকার হয়।

গাছ ফেলে ট্রেনটি থামিয়ে বৃষ্টির মতো পাথর ছুড়ে মারা হয়। এতে সাতটি বগির জানাল ভেঙে যায়। এরপর ট্রেনটি পিছিয়ে ভৈরব রেলওয়ে জংশন স্টেশনে নেওয়া হয়।

কিশোরগঞ্জ : দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর চালায় হেফাজতের কর্মীরা। বঙ্গবন্ধুর ছবিতেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ সময় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে হরতালকারীদের সংঘর্ষ হয়।

জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বকুল, বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক এনায়েত করিম অমি, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন, সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ নোমান খানসহ ৩৭ নেতাকর্মী ও পথচারী আহত হন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে।

কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ) : কটিয়াদীতে হেফাজত কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় পালটাপালটি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে কটিয়াদী মডেল থানার ওসি ও এসআইসহ ১১ জন পুলিশ সদস্য আহত হন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ৯৭ রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ।

সিরাজদিখান (মুন্সীগঞ্জ) : ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের সিরাজদিখানের নিমতলা এলাকায় হরতাল সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে ওসিসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন।

সড়কের অনেক জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন হরতাল সমর্থকরা। এ সময় হেফাজত কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের পালটাপালটি ধাওয়া হয়। হরতালকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছোড়ে।

নারায়ণগঞ্জ : ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সাইনবোর্ড এলাকা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের কাঁচপুর পর্যন্ত তাণ্ডব চালিয়েছে হরতালকারী।

সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দফায় দফায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হেফাজতের নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় ছয়জন গুলিবিদ্ধসহ কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়েছেন।

বিকালে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর হঠাৎ করেই অনেকটা ফিল্মি কায়দায় সাতটি যানবাহনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

নারায়ণগঞ্জ শহরের ডিআইটি এলাকায় ভোর থেকে হেফাজতের নেতাকর্মীরা রেলওয়ে ডিআইটি মসজিদের ভেতরে অবস্থান নেয়। সকাল ৭টার দিকে পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যেই হেফাজতের নেতাকর্মীরা মসজিদের বারান্দা ও আঙ্গিনায় হরতালের পক্ষে স্লোগান দেয়।

পরবর্তী সময়ে মহাসড়কে টায়ার জ্বালিয়ে ও বিদ্যুতের খুঁটি ও গাছের গুঁড়ি রাস্তায় ফেলে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে সাইনবোর্ড, সানারপাড়, মৌচাক ও ইউটার্ন এলাকায় হেফাজত নেতাকর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ বাধে।

পুলিশ টিয়ারশেল ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ সময় শফিকুল ইসলাম, শাহাদাত ও শাকিলসহ ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়। পুলিশসহ ২০ জন আহত হয়।

হরতালকারীরা তিনটি ট্রাক, একটি মাইক্রোবাস ও তিনটি বাসে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এছাড়া অ্যাম্বুলেন্স, সংবাদ মাধ্যমের গাড়িসহ অর্ধশতাধিক যানবাহন ভাঙচুর করা হয়।

ময়মনসিংহ : ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চুরখাই এলাকায় ব্যারিকেড দিয়ে ব্যাপক ভাংচুর চালায় হরতালকারীরা। এনা ও শৌখিন সার্ভিসের বাসসহ ২৫টি বাস ভাংচুর করা হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল পৌঁছে টিয়ার গ্যাস ও শর্টগানের গুলি ছোড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

সিলেট : সিলেটে সকাল থেকে ঢিলেঢালাভাবে হরতাল পালিত হয়। দেকানপাট বন্ধ ছিল। সকালে যানচলাচল কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানচলাচল বাড়ে।

দুপুরের দিকে নগরীর কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করার চেষ্টা করে হরতাল সমর্থক ছাত্রশিবিরও। এ সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের পালটাপালটি ধাওয়া হয়। এতে দুই ছাত্রলীগ কর্মীসহ পাঁচজন আহত হন।

ঘটনাস্থল থেকে পাঁচজনকে আটক করেছে পুলিশ। শিবিরের সঙ্গে পালটাপালটি ধাওয়ার ঘটনা ছাড়া নগরীতে হরতাল চলাকালে আর কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি।

হবিগঞ্জ : দুপুরে আজমিরীগঞ্জ উপজেলার বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ সড়কের নগর পয়েন্টে হরতালকারীদের রাস্তা অবরোধের খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে যায়। এ সময় মাইকে ঘোষণা দিয়ে ৭০০-৮০০ লোক জড়ো হয়।

এ সময় তারা হামলা চালিয়ে এএসআই নিজাম উদ্দিনসহ দুই দারোগার মোটরসাইকেল আগুনে পুড়িয়ে দেয়। ওসির গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। হামলায় আহত ওসি নূরুল ইসলাম, এসআই পুনয়েল ও এসআই নজিবরকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

কোম্পানীগঞ্জ (নোয়াখালী) : বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী চৌরাস্তায় ‘নোয়াখালী টিভি সাংবাদিক ফোরাম’ কার্যালয়ে অতর্কিত হামলা চালিয়েছে হেফাজতের নেতাকর্মীরা। তাদের ইটের আঘাতে চার সাংবাদিক আহত হন।

এ সময় দুটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। বেলা সোয়া ৩টার দিকে জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটে এ হামলার ঘটনা ঘটে। আহত সাংবাদিকরা হলেন-এশিয়ান টিভির জেলা প্রতিনিধি মানিক ভূঁইয়া, একাত্তর টিভির জেলা প্রতিনিধি মিজানুর রহমান, বাংলা টিভি জেলা প্রতিনিধি ইয়াকুব নবী ইমন ও ক্যামরাপার্সন মনির হোসেন।

কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) : কমলগঞ্জের মুন্সীবাজারে হেফাজত কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের কয়েক দফা পালটাপালটি ধাওয়া হয়। হেফাজত কর্মীদের ছোড়া ইটপাটকেলে এক সংবাদকর্মী ও এক পুলিশ সদস্য আহত হন।

চট্টগ্রাম ও হাটহাজারী : চট্টগ্রাম নগরীতে ঢিলেঢালাভাবে হরতাল পালিত হলেও জেলার বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ ও পিকেটিং হয়েছে। পটিয়া ও হাটহাজারীতে হরতালের সমর্থনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা।

এ কারণে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কে বাস চলাচল বন্ধ থাকে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের চট্টগ্রাম অংশে বাস-ট্রাকের মতো বড় আকারের যানবাহন চলাচল করেনি।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে বাস ছেড়ে গেলেও তা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় সংখ্যায় ছিল কম। চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে সকালের সব ট্রেন ছেড়ে যায়।

তবে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সোনার বাংলা ও মহানগর প্রভাতী পথে প্রতিবন্ধকতার কারণে বিকাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছাতে পারেনি।

এদিকে হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্রদের অবরোধ করে রাখা চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক রোববার রাতে খুলে দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার বিকাল থেকে মহাসড়কে অবরোধ করে রেখেছিল হাটহাজারী মাদ্রাসার বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে শুক্রবার মহাসড়ক কেটে লণ্ডভণ্ড করে ইটের দেওয়াল তুলে সেখানে বিক্ষোভ করছিল ছাত্ররা।

রাজশাহী : রাজশাহীতে হরতালের কোনো প্রভাব পড়েনি। জীবনযাত্রা স্বাভাবিক দেখা গেছে। কোথাও কোনো পিকেটিংয়ের খবরও পাওয়া যায়নি। তবে ভোরে মহানগরীর আমচত্বর এলাকায় ট্রাক টার্মিনালে দুটি বিআরটিসি বাসে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এটি হরতালকারীদের নাশকতা কি না, তা পুলিশ নিশ্চিত নয়।

এছাড়া খুলনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ, নরসিংদী, হবিগঞ্জের বানিয়াচং, শায়েস্তাগঞ্জ ও নবীগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নওগাঁর পোরশা, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও ফতুল্লায় শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালিত হয়েছে।

বগুড়া ও বরিশালের আগৈলঝাড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হরতাল পালিত হয়নি। ফরিদপুর, লক্ষ্মীপুর ও রায়গঞ্জ, নোয়াখালী ও চাটখিল, নেত্রকোনার দুর্গাপুর, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ, সাতক্ষীরা, খাগড়াছড়ি, গাজীপুরের শ্রীপুরে হরতালের বিপক্ষে যুবলীগ ও ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা মিছিল করেন। এ সময় হরতালকারীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এতে উভয়পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হন।

হেফাজতের নতুন কর্মসূচি : হরতালের সময় না বাড়িয়ে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সোমবার দেশব্যাপী দোয়া মাহফিল এবং আগামী শুক্রবার বিক্ষোভ মিছিল করবে সংগঠনটি।

রোববার বিকালে রাজধানীর পল্টনে হেফাজতের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদি এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলাম মোদির আগমন প্রত্যাহার করার জন্য কর্মসূচি দিয়েছিল।

মোদির আগমনের দিন হেফাজতের কোনো কর্মসূচি ছিল না। কিন্তু ওইদিন সাধারণ মানুষের আন্দোলনে প্রশাসন গুলি চালিয়েছে। যার প্রতিবাদে এ হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল।

দাবিদাওয়া মানা না হলে কঠিন কর্মসূচি দেওয়ার হুংকার বাবুনগরীর : হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, হেফাজতের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেছেন, হাটহাজারী, ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিলে গুলি চালানোয় ১৬ জন শহিদ হয়েছেন।

এ কারণে আমরা হেফাজতের পক্ষ থেকে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিই। তৌহিদি জনতার অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়েছে। হরতালে দেশের জনসাধারণ ও আলেম-ওলামারা সাড়া দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।

ইসলামবিরোধী কাজ হলে আলেম-ওলামারা এ রকমের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা বাধ্য হয়ে এ হরতাল দিয়েছি।

আমাদের এ হরতাল ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। প্রশাসনকে বলব, আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কেউ উসকানিমূলক কাজ করবেন না।

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন
Website Design and Developed By Engineer BD Network