২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

 

করোনার চলমান পরিস্থিতিতে স্কুল খুলতে করণীয়

আপডেট: মে ২৯, ২০২০

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন

 করোনার চলমান পরিস্থিতিতে স্কুল খুলতে করনীয়ঃ

………..মুহাম্মাদ মাসুম খান

 

 

♦ গত বছর ডিসেম্বরে চীনের উহান রাজ্যে অকল্পনীয় নজীর বিহীন প্রানঘাতী করোনা ভাইরাস সংক্রমনের যাত্রা শুরু করে ইতিমধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ মানুষের প্রান কেড়ে নিয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, অফ্রিকা সহ সারা বিশ্বের ২১০ টি দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। বাংলাদেশ ও করোনার ভয়াবহ থাবা থেকে মুক্ত নয়। করোনা সংক্রমনের বিস্তার প্রতিরোধে গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্দ। সারা পৃথিবীর শিক্ষা ব্যবস্থার ন্যায় বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও আজ লন্ডভন্ড হয়ে গেছে, থমকে গেছে শিক্ষার্থীদের কলরব,শ্রেনিকক্ষ,খেলার মাঠ,পাঠাগার, গবেষনাগার সব কিছুর কার্যক্রম। উন্নত বিশ্বে উচ্চ শিক্ষার শ্রেনি কার্যক্রম অন লাইনে চালাতে পারলেও স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ কোথাও এখন নেই। বাংলাদশে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হলেও অনলাইনে ক্লাস নেয়ার সংস্কৃতি এদেশে একেবারেই নতুন। তথাপীও সরকার শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে সংসদ টিভিতে নিয়মিত প্রথম শ্রেনি থেকে দ্বাদশ শ্রেনি পর্যন্ত ক্লাস প্রচার করছে।শিক্ষার্থীদের সেসব ক্লাস অনুসরন করে সে অনুযায়ী বাড়ির কাজ সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে অন লাইনে ফেইসবুক গ্রুপ খুলে,মেসেঞ্জারে, ইমু ব্যবহার করে ,মোবাইলে কল করে বিভিন্ন ভাবে চেস্টা করে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদেরকে পড়াশুনার সাথে সংশ্লিষ্ঠ রাখতে। বিশেষকরে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের সাধ্য অনুযায়ী অন লাইনে ক্লাস পরিচালনার চেস্টা করছেন কারন তারা ভাবছেন ক্লাস পরিচালনা না করলে পরবর্তিতে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি উঠানোতে সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলি বিশাল আর্থিক সমস্যার মধ্যে পরতে পারে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করছে এরকম নজীর খুব কমই আছে।যদিও কতজন শিক্ষার্থী সংসদ টিভি এবং অনলাইনে নেয়া সেসব ক্লাস অনুসরন করছেন বা অনুসরন করার সুযোগ পাচ্ছেন সেটা প্রশ্নের সম্মুখিন। অন লাইন বা টিলিভিশনের মাধ্যমে যত ক্লাসই নেয়া হউক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খুললে কোনভাবেই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে থেকে খুলা যাবে সেটাই হলো প্রশ্ন। বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত বিশ্বে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সার্বিক পরিস্থিতি অনেক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন এবং মান সম্মত হওয়া সত্বেও তারা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সাহস পাচ্ছে না। জার্মানীতে স্কুল কয়েকদিন খোলার রাখার পরে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী করোনা সংক্রমিত হওয়ায় আবার স্কুল বন্দ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক যে পরিস্থতি তাতে করোনা পরিস্থিতিতে স্কুল খুলে দেয়া অত্যন্ত ঝুকিপূর্ন এবং চ্যালিঞ্জিং। উন্নত বিশ্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, স্যানিটেশন ব্যবস্থা, শ্রেনি কক্ষে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের থেকে অনেক অনেক গুন উন্নত। সেসব দেশের সরকারই সিদ্ধান্তহীনতায় আছে স্কুল খুলার ব্যাপারে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে অবস্থা কি হতে পারে? ল করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এদেশে বেড়েই চলেছে।অফিস,আদালত,ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু করার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। কি হবে সামনের দিনগুলির পরিস্থতি? এত কিছুর মাঝেও স্কুল কবে খোলবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধু লেখাপড়াই না বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ছয় লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারির জীবন জীবীকা হুমকির সম্মুখিন। স্কুল বন্দ থাকার কারনে অধিকাংশ স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারিরা স্কুল প্রদত্ত বেতন পাচ্ছেন না। নন এম,পি,ও শিক্ষক থেকে শুরু করে এম,পি,ও ভুক্ত শিক্ষকগন ও চরম বিপদের মধ্যে দিন যাপন করছেন। এম,পি,ও ভুক্ত শিক্ষকগন মুল বেতনের সমপরিমান টাকা সরকার থেকে পেলেও শুধু মাত্র সে টাকায় বাড়ি ভাড়া দিয়ে চলা অসম্ভব। বিশেষকরে যারা মেট্রোপলিটন এলাকা, শহর এবং জেলা শহরে থাকেন তাদের জন্য শুধু মাত্র সরকার প্রদত্ত বেতন স্কেলের মুল বেতন দিয়ে চলা একেবারেই অসম্ভব। জনৈক একজন সহ প্রধান শিক্ষক ঢাকা শহরে থাকেন। সরকার থেকে ২৪০০০ টাকা পান। ঘর ভাড়া দেন ১২০০০ টাকা, ব্যাংক লোনের কিস্তি ৮০০০ টাকা। বাকী ৪০০০ টাকায় কিভাবে সংসার চালাবেন? সারা জীবন আদর্শ নিয়ে চলেছেন। প্রাইভেট ব্যাচ পড়াতেন না।দুই এক টা হোম টিউশনি করতেন একান্তই প্রয়োজনে। জমানো টাকা নেই বরং সংসার চালাতে যেয়ে ব্যাংক লোন করেছেন। কিভাবে সংসার চালাবেন? এরকম অনেক শিক্ষকই আছেন যারা এই দুই মাসে সংসার চালাতে যেয়ে জমানো টাকা শেষ করে ফেলেছেন, ধার নিয়েছেন,ক্রেডিড কার্ড থেকে লোন নিয়েছেন।অনেকে কোন ভাবে যেনতেন ভাবে ডাল -ভাত খেয়ে সময় কাটাচ্ছেন, পুস্টিহীনতায় ভুগছেন। এমতাবস্থায় স্কুল না খোললে, স্কুলের বেতন না পেলে অধিকাংশ শিক্ষক পরিবারকে চরম অভাবে অনাহারে, অর্ধাহারে থাকতে হবে।সরকারের পক্ষে সকল শিক্ষক-কর্মচারিদের বেতন দেয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব হলে নাহয় অন লাইন ক্লাস ব্যবস্তাপনা জোরদার করে স্কুল বন্দ রাখা যেত আরো অনেক দিন।তবে স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত দেয়ার আগে সরকারকে অবশ্যই কঠর নির্দেশনা এবং নীতিমালা নির্ধারন করে দিতে হবে। পাশাপাশি সেসব নীতিমালা মানা হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে কঠর তদারকি করতে হবে। নিন্মলিখিত পদক্ষেপ নেয়া সাপেক্ষ স্কুল খোলা যেতে পারেঃ
১.স্কুলে প্রবেশের পূর্বে শরীরের তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা করা।সেক্ষেত্রে জ্বর থাকলে স্কুলে আসতে বারন করা
২.প্রত্যেকে ছাত্র শিক্ষকের করোনা সনাক্তকরন পরীক্ষার ব্যবস্থা করা
৩.সামাজিক দুরত্ব মেনে স্কুলে প্রবেশ এবং বাহির নিশ্চিত করা।
৪.শ্রেনি কক্ষে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে শিক্ষার্থীদের বসানোর ব্যবস্থা।সেক্ষেত্রে ৩০-৪০ জনের বেশি এক কক্ষে না বসানোর ব্যবস্থা।
৫.স্কুলে প্রবেশের সময় হাত ধুয়ে, ইউনিফর্ম,জুতা,স্কুল ব্যাগ সব কিছু স্প্রের মাধ্যমে জীবানুনাশকের ব্যবস্থা করা
৬.বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা,বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত টয়লেট, হাত ধুয়ার বেসিন, সাবানের ব্যবস্থা, নিয়মিত সেগুলি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা নিশ্চিতকরন।
৭.কোন অবস্থায় যাতে শিক্ষার্থীরা সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা থেকে বিরত না থাকে সে ব্যবস্থা করা
৮.প্রয়োজনে কিছু দিন ক্লাস নিয়ে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে।এরমধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে ভাল।
৯। কয়েকটি বিদ্যালয়ের জন্য একজন করে ডাক্তার নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।
১০.অন লাইন ক্লাস যথাযথ ভাবে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে,শিক্ষার্থী স্কুলে না এসেও যাতে ক্লাস করতে পারে।
১১.শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির ইতিবাচক এবং শিক্ষামুলক ব্যবহারে অভ্যস্ত করতে হবে
১২.প্রত্যেকটি শিক্ষককের প্রযুক্তি ব্যবহার এবং অন লাইন ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা প্রদানে দক্ষ করে তোলা
১৩.শিক্ষার্থী, শিক্ষক,অভিভাবক সবাইকে মাস্ক পড়তে হবে।
১৪.অনলাইন ব্যাংকিং এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি দেয়ার ব্যবস্থা করা।
করোনার মহামারি আমাদের অনেক দৈন্যতা,উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম এবং দূর্নীতিকে আমাদের সামনে তুলে ধরছে। দেশে যদি যত্র তত্র নিয়ম নীতির তোয়াক্কা নাকরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠত আবার কতিপয় প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র সাম্রাজ্যবাদ এবং বানিজ্য না থাকত, প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা যদি যথাযথ হতো,স্বাস্থ্যবিধি,প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্লাস নেয়ার সরকারি নির্দেশনা যদি যথাযথভাবে মানা হতো তাহলে মাত্র দুই মাস বন্দ থাকাতে শিক্ষা ব্যবস্থা এরকম ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়তো না। করোনা পরবর্তি সময়ে বিষয়গুলি বিবেচনায় রেখে ক্যাচমেন্ট এরিয়াভিত্তিক পরিপূর্ন সরকারি ব্যবস্থাপনার ন্যয্যতা এবং সাম্যতার ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিচালনা করতে হবে।বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বানিজ্যিকরন আর সরকারি ব্যবস্থাপনার নামে তদারকহীনতা, উদাসীনতা কোনটাই শিক্ষা ব্যবস্থায় কাম্য নয়।

লেখক : মুহাম্মাদ মাসুম খান,কেন্দ্রিয় কার্যনির্বাহী সদস্য, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ। 

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন
Website Design and Developed By Engineer BD Network