২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

 

পাঠ প্রতিক্রিয়া : রাশেদ রহমানের উপন্যাস পতিতামঙ্গল

আপডেট: মে ৪, ২০২০

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন

 

পাঠপ্রতিক্রিয়া
কথাশিল্পী রাশেদ রহমানের উপন্যাস
” পতিতামঙ্গল “
################

কাশিনাথ মজুমদার পিংকু : স্বপ্ন কিংবা স্বপ্নের ছায়া (২০০৬ )এবং শহীদ সতীশচন্দ্র দাস সড়ক (২০১৭ )-এর পর ২০২০ সালের একুশে গ্রন্থমেলায় নাগরী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে কথাশিল্পী রাশেদ রহমানের তৃতীয় উপন্যাস “পতিতামঙ্গল”। রাশেদ রহমানের লেখা মানেই ভিন্ন স্বাদের কিছু উপস্থাপনা। সে গল্প, কবিতা কিংবা উপন্যাস যাই হোক। এক্ষেত্রেও তাঁর ব্যতীক্রম ঘটেনি । প্রকাশক তার মুখবন্ধে এটিকে বিরল-প্রকৃতির উপন্যাস বলে আখ্যা দিয়েছেন। কারণ এর উপস্থাপন ভঙ্গি, গঠন ও বিষয়বস্তু গতানুগতিক উপন্যাসগুলির চেয়ে ভিন্নতো বটেই এর রুপ রস গন্ধও পাঠককে এক আলাদা ভাবনার জগতে নিয়ে যায়।

টাঙ্গাইলের নিষিদ্ধ এলাকা ও অন্ধকার জগতের মানুষদের জীবনসংগ্রামের এক বাস্তব ও করুণচিত্র বর্নিত হয়েছে উপন্যাসটিতে। মোট দশটি পর্বে লেখা এই উপন্যাসটি। প্রতিটি পর্বের একটি করে নামকরন রয়েছে যা আলাদা আলাদাভাবে এক একটি গল্পও হতে পারতো। কোন কোন পর্বে রয়েছে আবার উপ-পর্বও। উপন্যাসের গল্পবয়ন অথবা শব্দবিন্যাস লেখক যেন ” একজন রাশেদ রহমান”-এর মতো করেই করেছেন। কারণ সাহিত্যে রাশেদ রহমানের নিজস্ব একটা জগত আছে। আর সেই জগতে পাঠক হিসেবে যারা বিচরণ করেন তারা লেখকের নাম জানা ছাড়াও যদি পতিতামঙ্গল উপন্যাসটি পড়া শুরু করেন, তাহলে বলে দিতে পারবেন এটি রাশেদ রহমানেরই লেখা।

প্রথম পর্ব ‘গৌরচন্দ্রিকা’ ছাড়া বাকী নয়টি পর্বেই লেখক স্বামীপরিত্যক্তা, স্বামীর নির্যাতনে ঘরছাড়া, প্রেমের বলি, ধর্ষিতা অথবা জাতকুলহারা কোন না কোন মেয়ের পতিতাবৃত্তির পথ বেছে নেওয়ার নেপথ্য কাহিনী বর্ণনা করেছেন। পতিতাপল্লীর সব মেয়েরই আছে আলাদা আলাদা গল্প। আর সেই অজানা গল্পের সাথে বর্ণনা করেছেন তাদের প্রতি নানা অন্যায়, অবিচার আর অমানুষিক নির্যাতনের করুন কাহিনীও। উঠে এসেছে সমাজপতিদের হাতে তাদের শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস। সমাজপতিদের জুলুম আর অত্যাচারের আরশ কাঁপানো গল্প। প্রেক্ষাপট বর্ণনায় স্বভাবতই গল্পে উঠে এসেছে সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষের চরিত্র। যেখানে বাদ যায়নি কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাংস্কৃতিক সংগঠক থেকে শুরু করে মদখোর- গাঁজাখোর- ব্রাহ্মণ- মসজিদের ইমাম, শ্রমিক,ব্যবসায়ী, ডাক্তার, এনজিও কর্মী, রাজনৈতিক নেতা, তাদের পোষা গুন্ডা, চ্যালাচামুন্ডা, প্রশাসনের ছোট-বড় কর্মকর্তা অথবা রাজা জমিদাররাও। সমাজের প্রতিনিধিত্ব করা কোন চরিত্রই যেন আমাদের অচেনা নয়। মুখোশের আড়ালে থাকা চরিত্রগুলোকে উন্মোচনের কী নিদারুন প্রচেষ্টা এই উপন্যাসটির মধ্য দিয়ে। চরিত্রই যেখানে মুখ্য নামতো সেখানে উপলক্ষ্য মাত্র।

এই উপন্যাসটিতে একক কোন গল্পকথক নেই। গল্পের প্রয়োজনে লেখক যখন যাকে প্রয়োজন মনে করেছেন তার মুখ দিয়েই গল্পের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। । রাশেদ রহমানের এই উপন্যাসটিতে টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। কাহিনীর প্রয়োজনে রয়েছে কিছু অশ্লিল শব্দ ও বাক্যের সংমিশ্রন । আমাদের তথাকথিত ভদ্রসমাজের কাছে এই মানুষগুলি অথবা তাদের মুখের ভাষা অচ্ছুদ হলেও ভাষার গভীরতায় প্রতিটি বর্ণে লুকিয়ে আছে অশ্রদ্ধা, অপমান, ঘুণা আর দুর্বিসহ জীবনের নানা ধরণের চাঁপা প্রতিবাদ। একজন নগন্য পাঠক হিসেবে আমার কাছে শব্দ অথবা বাক্যগুলিকে উপন্যাসের অলংকরণ বলেই মনে হয়েছে। গল্পের একদিকে যেমন বর্ণনা করা হয়েছে পতিতাপল্লীর নানা ধরণের বিশ্বাস-অবিশ্বাস,স্বভাব- অাচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার অন্যদিকে ‘বকুলশহর’ নামে পরিচিত কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া টাঙ্গাইলের ইতিহাস-ঐতিহ্যও। বৃট্রিশ আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত শহরের নানা রাস্তা এবং এলাকার বর্ণনা অনেক পাঠককে নিয়ে যেতে পারে স্মৃতির রোমন্থনে।

উপনাস্যের সব কাহিনীর মাঝে থাকে ভিন্ন কাহিনী অথবা গল্পের মাঝে থাকে ভিন্ন আরেক গল্প। পতিতাপল্লীতে জন্ম নেওয়া অথবা বেড়ে উঠা ছেলের অভিশপ্ত জীবনকথা উপন্যাসটিকে কখনো কখনো করেছে আরও বেশী মর্মস্পর্শী।
আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার মুখে এ যেন এক চপেটাঘাত। “—– আমরা পাড়ার ছেলে। হিন্দু না মুসলমান তাই তো জানি না। আমাদের আবার ধর্ম কীসের? ——পাড়ার মা-বোনদের তবু একটা ধর্ম আছে। খদ্দেরকে সুখী করা। বেঁচে গেছি— আমাদের কোন ধর্ম নাই——।” জীবন সম্পর্কে কতটা অনীহা  আর ঘুণার জন্ম হলে রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষ কথাগুলো বলতে পারে তা অতি সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু পতিতাপল্লীতে বসবাস করা মানুষগুলিরও একটা সুন্দর মনে আছে, হৃদয়ে আছে প্রেম-প্রীতি -ভালবাসা। আছে দেশপ্রেম। দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসা। দেশ ও সমাজের মঙ্গলের জন্য আলাদা  ভাবনা। আছে বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই। যে লড়াই থেকে মুক্তির স্বাদ তাদের কাছে থেকে যায় যোজন যোজন  দূরে। তাদের আছে নীতি-আদর্শ আর ধর্মবিশ্বাস। যেসব নীতি-আদর্শ আর ধর্মবিশ্বাস সমাজের অনেক আদর্শবান,নীতিবান অথবা ধার্মিককেও লজ্জায় ফেলতে পারে অনায়াসে।

এই উপন্যাসের চুম্বক অংশের চুম্বক কিছু প্রশ্নের উত্তর অথবা অসমাপ্ত কিছু বাক্যের শূণ্যস্থান পূরণ করতে অনেক পাঠককেই হিমসিম খেতে হবে -এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কারণ কথাশিল্পী রাশেদ রহমান গল্পের অন্তরালে এক অন্যগল্প শুনিয়েছেন। সরাসরি কোন কথা না বলেও অনেক কথা বলে গেছেন। তবে পাঠকসমাজ সে ভাষা বোঝার আশা জলাঞ্জলি দেবে কী-না সময় সেটা ভালো বলতে পারবে। সাহিত্যের সৃষ্টি কালোত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সময়ের প্রয়োজন। আর উপন্যাসটিকে পুরোপুরি উপলব্ধি করার জন্য আমরা না হয় সেই সময়ের অপেক্ষায় থাকি। জয়তুঃ কথাশিল্পী রাশেদ রহমান।

লেখক : কাশীনাথ মজুমদার পিংকু
শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মী
এলেঙ্গা, টাঙ্গাইল।

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন
Website Design and Developed By Engineer BD Network