আপডেট: জুলাই ১, ২০২১
নেক্সটনিউজ ডেস্ক : হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, জাতীর মহান নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের সংযুক্ত ছাত্র ছিলেন তিনি। থাকতেন মোগলটুলীতে। একটি সাইকেলে চড়ে আসতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে আহূত ধর্মঘটে পিকেটিং করার সময় গ্রেফতার হন তরুণ ছাত্র শেখ মুজিব। রোষানলে পড়েন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর। ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যোগ দিয়ে বহিষ্কৃত হন। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আর পড়াশোনা করা হয়ে উঠেনি তার। তবে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেন স্বাধীনতার এই মহানায়ক। ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর সেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
দেশ স্বাধীনের পর শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী সংস্কারের উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে তার অনেক পরিকল্পনা ছিল। এরই অংশ হিসাবে ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির ১১ নম্বর আদেশের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডারের পার্ট-১-এর প্রথম পাতায় উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী, এই আদেশ ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর বলে গণ্য হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে সব সময় সদয় মনোভাব পোষণ করতেন। রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর হিসাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগদান করে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করবেন-এমন পরিকল্পনা ছিল তার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন বিশেষ করে ঢাকার অংশ, শাহাদতবরণের পূর্বদিন পর্যন্ত, পুরোটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে আবর্তিত। কারণ ওইদিনও (১৫ আগস্ট) বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, সেই সোনালি আলোর ভোর আর হয়নি। ছাত্রনেতা, যুবনেতা, আওয়ামী লীগ নেতা, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-জাতির পিতার সব অভিধা, পরিচিতি, কার্যবলয় ও কর্মবলয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে। তিনি নেই; কিন্তু তার রেখে যাওয়া শিক্ষাদর্শন আমাদের নৈতিক শক্তির ভিত্তি হিসাবে রয়ে গেছে।
উপাচার্য আরও বলেন, বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু একই সূত্রে গাঁথা।
বঙ্গবন্ধু এই বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি নিজের মধ্যে এমনভাবে ধারণ করতেন যে, রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী আর ভাইস চ্যান্সেলরের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব কখনো তিনি করেননি। সরকারপ্রধান হলেও তিনি প্রয়োজনে চলে আসতেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ ক্যাম্পাসে তার অনানুষ্ঠানিক আগমনও ছিল। যেমন, গাড়িতে যাওয়ার সময়ে ইউল্যাব স্কুলের পাশে থেমে শেখ রাসেলকে পাঠিয়ে দিতেন আবার কোনোদিন বাসায় ফেরার পথে নিয়ে যেতেন। এই যে ভিন্নধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি, তারও তুলনা হয় না।
বহিষ্কারদেশে ও তা প্রত্যাহার : ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধুর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। সেই বছরের ১৪ আগস্টের সিন্ডিকেট সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ১৯৪৯ সালের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য তৎকালীন আইন বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র (রোল-১৬৬, এসএম হল) শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিত কাউন্সিল ২৬ মার্চ, ১৯৪৯ সালে যে জরিমানা ও অভিভাবক প্রত্যায়িত মুচলেকা প্রদানের ও অনাদায়ে ছাত্রত্ব বাতিলের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, আজকের সিন্ডিকেট সেই সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক ও ন্যায় বিচারের পরিপন্থি হিসাবে গণ্য করে।’
বিবরণীতে আরও বলা হয়, ‘সভা মনে করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তিকৃত ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন ও নেতৃত্বদান ছিল তার অসাধারণ দূরদর্শী ও জ্ঞানদীপ্ত গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। অধিকন্তু এটি ছিল ওই সময়ের সাহসী ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে একটি সাহসী পদক্ষেপ। কর্মচারীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ ছিল যথার্থ। তাকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, অনৈতিক, ন্যায়বিচার ও রুল অব অডি আলট্রাম পার্টেম-এর পরিপন্থি ছিল বলে আজকের সভা মনে করে। তাই ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত উক্ত বহিষ্কারাদেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সর্বসম্মতিক্রমে প্রত্যাহার করছে।’
বিবরণীতে আরও বলা হয়, ‘এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সিদ্ধান্তানুযারী জরিমানা ও মুচলেকা প্রদান না করে সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান যে সাহসী প্রতিবাদী ভূমিকা রেখেছিলেন তা এ সভা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪৯ সালে ৪র্থ শ্রেণি কর্মচারীদের আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন, এ সভা তাদের প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে। এ সভা মনে করে, এ বহিষ্কারাদেশ বহু পূর্বেই প্রত্যাহার করা উচিত ছিল।’
এসএম হলে যে তথ্য রয়েছে : সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করে হল কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে লিখিতভাবে হলের পক্ষে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে তিন অধ্যাপকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘তারা সকলে এ মর্মে মত দেন যে, বঙ্গবন্ধু এসএম হলের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। এই হল কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। হলের কোন নির্দিষ্ট কক্ষে তিনি থাকতেন বলে এদের কারোর জানা নাই। বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে গবেষণারত স্বপন কুমার দাস দাবি করেন যে, বঙ্গবন্ধু হলের ১৫২নং কক্ষে ছিলেন। বর্তমান ছাত্রদের কেউ কেউ বলেছেন যে, তিনি ১২নং কক্ষে ছিলেন বলে শোনা যায়। কিন্তু এদের কেউ এ ধরনের তথ্যের উৎস সম্পর্কে কিছু বলতে পারেননি।’
ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘হলের প্রাধ্যক্ষ একটি রিপোর্টে বঙ্গবন্ধু ১২নং কক্ষে থাকতেন বলে শুনেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তথ্যের উৎস অজানা। হল অফিসে ১৯৭১ সালের আগের এমন কোনো কাগজ সংরক্ষিত নেই যার মাধ্যমে এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট উপসংহারে পৌঁছানো যায়। সুতরাং উপসংহারে বলা যায় যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসএম হলের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। তিনি নিয়মিতভাবে হলে থাকতেন না। রাজনৈতিক কারণে হলে থাকলেও তিনি কোন কক্ষে থাকতেন তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।’