৯ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার

 

মুক্তি পাননি সাংবাদিক রোজিনা : আদেশ রোববার

আপডেট: মে ২১, ২০২১

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন

নেক্সটনিউজ প্রতিবেদক, ঢাকা :  সরকারি ‘গোপন নথি’ সরানোর মামলায় প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের জামিন বিষয়ে রোববার আদেশ দেওয়া হবে। বৃহস্পতিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বাকী বিল্লাহর ভার্চুয়াল আদালতে জামিন শুনানি হয়। শুনানি শেষে আদালত আদেশ অপেক্ষমাণ রাখেন। পরে রোববার আদেশ দেওয়া হবে বলে জানান আদালত। এদিকে রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে রাজধানীসহ সারা দেশে সমাবেশ ও মানববন্দন কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে শুনানি শুরু হয়। ১ ঘণ্টার অধিক সময় ধরে শুনানি চলে। দুপুর ১টা ৫৬ মিনিটের দিকে শুনানি শেষ হয়। রোজিনা ইসলামের পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী এহেসানুল হক সমাজী, আশরাফুল আলম, আমিনুল গণি টিটো, প্রশান্ত কুমার কর্মকার, ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আব্দুর রশিদ জামিন শুনানি করেন। এছাড়া রোজিনা ইসলামের পক্ষে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, মহিলা পরিষদ ও ব্লাস্টের একাধিক আইনজীবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

শুনানিতে এহেসানুল হক সমাজী বলেন, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে অজামিনযোগ্য ধারার কোনো অভিযোগ বর্তায় না। প্রথমে যদি চুরির কথা বলা হয়ে থাকে। আপনি (আদালত) দেখবেন, এ এজাহারে চুরি হওয়া কোনো ডকুমেন্টের বর্ণনা দেওয়া আছে কিনা। অর্থাৎ আসামি কিছু চুরি করলে অবশ্যই তা এজাহারে উল্লেখ করতে হবে। এ মামলার এজাহারে কোথাও কোনো চুরিকৃত ডকুমেন্টের বর্ণনা নেই। এরপর জব্দ তালিকায় দেখা যায়- রোজিনা ইসলামের দখল থেকে কথিতমতে কোনো ডকুমেন্ট উদ্ধার হয়নি। সেখানে ডকুমেন্টগুলো উপস্থাপন করেছেন কথিত ঘটনাস্থলের একজন সরকারি কর্মকর্তা। সুতরাং আসামির বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য ধারার অপরাধ এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

তিনি আরও বলেন, শত্রুভাবাপন্ন ব্যক্তি বা কোনো রাষ্ট্রের কাছে আসামি কোনো ডকুমেন্ট সরবরাহ করেননি। আসামির জামিনে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত অধিকার তিনি সংরক্ষণ করেন। এটি তার প্রতি কোনো দয়া নয়, অনুকম্পা নয়, সহানুভূতি নয়, কোনো মানবিক বিষয় নয়।
এটি হচ্ছে তার প্রাপ্য, যা আইনে তাকে দেওয়া হয়েছে। এরপরও তিনি একজন মহিলা এবং অসুস্থ। যেহেতু অপরাধ জামিনযোগ্য, যেহেতু তিনি নারী, যেহেতু তিনি অসুস্থ, যেহেতু কথিতমতে কোনো ডকুমেন্ট তিনি চুরি করেছেন তার কোনো বর্ণনা নেই, তার কাছ থেকে কোনো উদ্ধার নেই, গুপ্তচরবৃত্তির কোনো অভিযোগ নেই, কোনো রংফুল কমিউনিকেশনের কোনো অভিযোগ নেই- সুতরাং এ মামলা স্বাভাবিক যে প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হচ্ছে তা শুধু আদালতের সময়ের অপচয়। কাজেই বিনয়ের সঙ্গে নিবেদন যে, আইনি ব্যাখ্যাগুলো আপনি (আদালত) আমলে নেবেন। আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও সৃজিত। আসামি জামিন পাওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন। জামিন পেলে তিনি এর অপব্যবহার করবেন না। আদালতে উপস্থিত থাকবেন।

শুনানিতে আশরাফুল আলম বলেন, এজাহারে বলা হয়, দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে রোজিনা ইসলাম ওই দপ্তরে প্রবেশ করেন। ঘটনাটি সে সময়ের। আর মামলা করা হয়েছে রাত ৮টা ৫৫ মিনিটে। পাঁচ-ছয় ঘণ্টা ধরে ওই রুমে আটকে রেখে তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। ২টা ৫৫ মিনিটের ঘটনা, জব্দ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। যদিও বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, রোজিনা ইসলামের কাছে বিভিন্ন পুলিশ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।

যেহেতু পুলিশ কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত ছিলেন, সেহেতু রোজিনা ইসলাম কোনো নথি চুরি করে থাকলে সঙ্গে সঙ্গে তা জব্দ করার কথা। এ কারণে ঘটনাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এ আইনে কোনো মামলা হয়নি। ২০১৮ সালের ১৯ মে দিল্লির অতিরিক্ত দায়রা জজ ভারতের হাইকমিশনার মাধুরী গুপ্তাকে ৩ বছরের সাজা দিয়েছিলেন। কারণ তিনি ভারতের গুপ্ত নথি আইএসের কাছে পাচার করেছিলেন। এরপর ২০১৯ সালের ভারতের হাইকোর্ট এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে করা মামলার রায়ে বলেছেন, সাংবাদিকরা যে তথ্য নেন, তা এ আইনের আওতায় মামলায় হবে না। আসামি নির্দোষ, যে কোনো শর্তে জামিন চাচ্ছি।

শুনানিতে আমিনুল গণি টিটো বলেন, অপরাধ সংঘটিত হয়নি। এখানে শুধু অনুমান করা হয়েছে। তারা (বাদীপক্ষ) বলছেন, এসব তথ্য জনসম্মুখে প্রচার হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখানে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। এর মানে এই নয় যে, অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। তারা অন্তর্যামী নন। রোজিনা ইসলামের সঙ্গে কোনো শত্রু রাষ্ট্রের সম্পর্ক আছে- এমনও নয়। ভ্যাকসিন কেনা একটি জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় নয়। কেন তাকে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হলো- কারণ এ রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কে অনেক রিপোর্ট করেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রোজিনা ইসলামকে শত্রু ভাবে। তারা (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা) বলছেন, ছবি তুলেছেন রোজিনা ইসলাম। আমি বলব ৫ ঘণ্টা আটকে রেখে যদি ছবি তোলা হয় তাহলে তারাই তুলেছেন, রোজিনা ইসলাম নন। আসামির যে কোনো শর্তে জামিন প্রার্থনা করছি।
প্রশান্ত কুমার কর্মকার বলেন, এ ঘটনাস্থল সচিবের একান্ত সচিবের দপ্তরে। আর মামলাটি করেছেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব। যিনি মামলা করেছেন তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেনই না। রোজিনা ইসলামকে বলা হচ্ছে ‘জনৈক রোজিনা ইসলাম’। এক যুগের অধিক সময় ধরে তিনি প্রথম আলোতে সাংবাদিকতা করেন। তাকে চেনেন না, তাকে বলা হচ্ছে জনৈক। এ এক বক্তব্যের মাধ্যমেই বলা যায় যে মামলাটি সৃজিত।

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, মামলাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। যিনি মামলা করছেন তিনি ওই ভবনে বসেনই না। তিনি বলেন, যদি আসামি নারী হন আর অসুস্থ হন। তাহলে এগুলোই যথেষ্ট তাকে জামিন দেওয়ার জন্য। এছাড়া কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায়ও আপনি (আদালত) জামিন দিতে পারেন।

আব্দুর রশিদ বলেন, এটা কোনো নিষিদ্ধ বিষয় নয়, গোপন শাখা নয়। নিষিদ্ধ এলাকা হতে হলে তাকে সরকার কর্তৃক গেজেটের মাধ্যমে হতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোনো নিষিদ্ধ এলাকা নয়। তথ্য সুরক্ষা আইন উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য প্রকাশের কারণে তথ্য প্রকাশকারীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি বা দেওয়ানি বা বিভাগীয় মামলা করা যাবে না। আসামি নির্দোষ। যে কোনো শর্তে জামিন প্রার্থনা করছি।

অপরদিকে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ বলেন, এ মহামারির সময়ে করোনা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী নিজে সব বিষয় দেখভাল করছেন এবং নির্দেশনা দিচ্ছেন। বিদেশ থেকে করোনার টিকা আনার জন্য যে গোপনীয় নথি তা আসামি নেওয়ার চেষ্টা করেন এবং শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে লুকিয়ে রাখেন। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই তিনি সেগুলোর ছবি তোলেন এবং নথি নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সেই সময় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও পুলিশ তাকে আটক করে। এ মামলা জামিন অযোগ্য ধারায়।

তিনি আরও বলেন, রোজিনা ইসলামকে যখন আটক করা হয়, তখন তিনি দোষ স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি অন্যায় করেছি, আর কখনও করব না। সেই ভিডিও আমরা আদালতে দাখিল করব। এরপর আদালত আসামির জামিনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। বাংলাদেশের অফিসিয়াল গোপনীয়তাকে চরমভাবে বিঘ্নিত করেছেন। আমরা ওই ভিডিও ফুটেজ আদালতে উপস্থাপন করব। আসামি জামিন পেলে মামলার সাক্ষীদের চরমভাবে প্রভাবিত করবেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত আদেশ অপেক্ষমাণ রাখেন এবং পরে রোববার আদেশ দেবেন বলে জানান। শুনানিকালে আদালতের সামনে গণমাধ্যমকর্মীরা ভিড় করেন। সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন রোজিনা ইসলামের স্বজনরাও।

এর আগে মঙ্গলবার রোজিনা ইসলামকে আদালতে হাজির করে ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। অপরদিকে রোজিনা ইসলামের পক্ষে রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করা হয়। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত রিমান্ড আবেদন নাকচ করে জামিন শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করেন।

রোজিনা ইসলাম পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। স্বাস্থ্য সচিবের পিএস সাইফুল ইসলামের রুমে ফাইল থেকে গোপন নথি সরানোর অভিযোগে তাকে আটকে রাখা হয়। তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

রোজিনা ইসলামকে আটকে রাখার খবর পেয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। তারা রোজিনাকে আটকে রাখার কারণ জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কিছুই জানাননি। রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত সাংবাদিকরা সচিবালয়ের বাইরে একত্রিত হয়ে রোজিনা ইসলামকে হেনস্তার প্রতিবাদ করেন। সাড়ে ৮টার পর রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য সচিবের পিএসের রুম থেকে বের করে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। মধ্যরাতে তার বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা করা হয়।

মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন সংগঠনের সমাবেশ ও মানববন্ধন : কারাবন্দি রোজিনা ইসলামের নিঃশর্ত মুক্তি এবং তাকে হেনস্তাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। তারা রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে করা মামলা প্রত্যাহার দাবি করেন। বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) আয়োজিত ‘অবিলম্বে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের মুক্তি চাই ও স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের শাস্তি চাই’ শীর্ষক মানববন্ধনে এ দাবি করা হয়।
মানববন্ধনে ডেইলি অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, রোজিনা ইসলাম সত্য প্রকাশ, অবাধ তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতীক ও সংগ্রামী। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতীক তিনি। রোজিনা ইসলাম অপরাধ করেননি। তার বিরুদ্ধে যারা

বেআইনিভাবে মামলা দিয়েছেন এবং গ্রেফতার করেছেন তাদের বিরুদ্ধে নিন্দা জানানো এবং তাদের বিচারের দাবিতে আমরা আজ সমবেত হয়েছি। রোজিনার বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে, তিনি তথ্য বা গোপন নথি চুরি করেছিলেন। কোন তথ্যের কথা বলা হচ্ছে? তিনি তো সেখানে টাকা-পয়সা চুরি করতে যাননি, সেখানে কম্পিউটার চুরি করতে যাননি। তাদের কথা যদি আমি মেনে নিই, তাহলে তিনি তথ্য চুরি করতে গিয়েছিলেন।

কিন্তু ওই তথ্য তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়, সে তথ্য জনগণের। কর্মকর্তারা জনগণের যে তথ্য গোপন করে রেখেছিলেন সেটি নিয়ে জনগণকে উপহার দেওয়ার জন্য রোজিনা গিয়েছিলেন। যখন প্রধানমন্ত্রী অবাধ তথ্য অধিকার আইন জাতীয় সংসদে ২০০৯ সালে পাস করেছিলেন, তারপর এই অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট অবাধ তথ্য আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটি থাকতে পারে না। শুধু রোজিনার মুক্তি নয়, সাংবাদিকতার স্বাধীনতার জন্য, সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্য সাংবাদিক সংগঠনগুলো শনিবার বাস্তবসম্মত গ্রহণযোগ্য কর্মসূচি ঘোষণা করবে।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মোল্লা জালাল বলেন, আমরা বেশি কিছু চাই না। আমরা রোজিনার নিঃশর্ত মুক্তি চাই। মামলা প্রত্যাহার চাই। হেনস্তাকারীদের শাস্তি এবং এ ঘটনা অনুসন্ধানের জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি চাই। যাতে সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ থাকবে।

রোজিনা ইসলামের ওপর যে ধরনের নির্যাতন হয়েছে, তা সভ্য দেশে হতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোনো সাংবাদিককে আটকে রাখতে পারে না। একটা নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি করতে হবে যেখানে সাংবাদিকদের প্রতিনিধিরা থাকবেন। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেউ থাকতে পারবেন না।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, রোজিনা ইসলাম সৎ, সাহসী ও পরিশ্রমী সাংবাদিক। তার বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে, তা গুপ্তচরবৃত্তির। গুপ্তচরবৃত্তি আর সাংবাদিকতা এক নয়। যে আইনে মামলাটি করা হয়েছে, আইনটি মৃত।

সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংবাদিকরা মনে করেন, রোজিনার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে। এ ঘটনায় অতিরিক্ত সচিব মূল অভিযুক্ত। তিনি নিজে রোজিনাকে হেনস্তা করেছেন, তার গায়ে আঘাত করেছেন। অতিরিক্ত সচিবের তদন্ত করার জন্য যুগ্ম সচিব দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এটি একটি হাস্যকর ঘটনা।

সভাপতির বক্তব্যে ডিইউজের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, রোজিনা ইসলামকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের যখন যেটা লাগবে তখন সেই ফাইল, ফাইলের পাতা নিজেরা ছিঁড়ে দিয়ে দেন। এমনকি যেখানে আপনার স্বার্থ আছে সেই ফাইলের পাতা আপনি সাংবাদিকের বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসেন। আপনারাই সর্বপ্রথম অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট লঙ্ঘন করেন এবং এর জন্য দায়ী হবেন আপনারাই।

রোজিনা ইসলামকে হেনস্তার ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির সমালোচনা করেছেন ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু। তিনি বলেন, আমলাতন্ত্রের নেতৃত্বে কোনো কমিটি আমরা চাই না। সবচেয়ে বড় কষ্ট, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয় হলো তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। এসব নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

মানববন্ধনে আরও বক্তব্য দেন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আবদুল মজিদ, সাবেক মহাসচিব আবদুল জলিল ভূঁইয়া এবং ওমর ফারুক, বর্তমান কোষাধ্যক্ষ দীপ আজাদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী, কাজী রফিক, বর্তমান সহ-সভাপতি আবদুল কুদ্দুস, যুগ্ম-সম্পাদক খায়রুল আলম, কোষাধ্যক্ষ আশরাফুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক জিহাদুর রহমান জিহাদ, প্রচার সম্পাদক আসাদুজ্জামান, দপ্তর সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌস চৌধুরী সোহেল, ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিলের সভাপতি মামুন ফরাজী প্রমুখ।

এদিন জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক সংস্থা, ঢাকা বিভাগ সাংবাদিক সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন পৃথক মানববন্ধন করে। একই ইস্যুতে প্রতিবাদ সমাবেশ করে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)। সংগঠনটির সভাপতি মোরসালিন নোমানীর সভাপতিত্বে ডিআরইউ প্রাঙ্গণে সমাবেশে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ, ক্র‌্যাব নেতা পারভেজ খান, নিত্য গোপাল তুতু, টিআরএনবির সভাপতি রাশেদ মেহেদী, র‌্যাকের সাধারণ সম্পাদক আহমেদ ফয়েজ, ডিকাব সভাপতি পান্থ রহমানসহ ডিআরইউর বর্তমান ও সাবেক নেতারা বক্তব্য দেন।

রোজিনার মুক্তির দাবিতে এদিন প্রতিবাদ সমাবেশ করে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)। রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে সমাবেশে দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের যুগ্ম সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু, ইআরএফের সাবেক সভাপতি মনোয়ার হোসেন, জাকারিয়া কাজল, খাজা মাঈনুদ্দিন ও সুলতান মাহমুদ বাদল, সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম, শহীদুজ্জামান, সাজ্জাদুর রহমান ও জিয়াউর রহমান, শরীয়তপুর সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চঞ্চল, একাত্তর টেলিভিশনের সিনিয়র বিজনেস এডিটর কাজী আজিজুল ইসলাম এবং ইআরএফের অর্থ সম্পাদক রেজাউল হক কৌশিক প্রমুখ বক্তব্য দেন। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি শারমীন রিনভী। সমাবেশ সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এসএম রাশিদুল ইসলাম।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নিন্দা : সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা করার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। সংগঠনটির সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. ফরিদা ইয়াসমিন বারী ও মহাসচিব অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া এক বিবৃতিতে বলেন, সচিবালয়ের মতো জায়গায় একজন সাংবাদিককে এভাবে হেনস্তা লজ্জাজনক।

রোজিনার গ্রেফতার গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর চরম আঘাত -হিউম্যান রাইটস ওয়াচ : সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গ্রেফতার গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর চরম আঘাত এবং তা বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানরত অন্যান্য সাংবাদিককেও একটি ভীতিকর বার্তা দিচ্ছে বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। বৃহস্পতিবার পাঠানো সংস্থাটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়।

রোজিনার মুক্তি চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল প্রেস ক্লাব : রোজিনা ইসলামকে গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল প্রেস ক্লাব এবং ন্যাশনাল প্রেস ক্লাব জার্নালিজম ইনস্টিটিউট। একই সঙ্গে তাকে মুক্তি দিতে আদালতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা। নিজস্ব ওয়েবসাইটে দেওয়া এক বিবৃতিতে তারা এ দাবি জানায়।

জেবুন্নেসার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ অনুসন্ধান করবে দুদক : স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা বেগমের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার জহুরুল হক। বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি একথা বলেন।

জানা যায়, দুদকের গোয়েন্দা বিভাগ দেশজুড়ে আলোচিত অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসার অর্থ সম্পদের বিষয়ে গোপনে অনুসন্ধান শুরু করেছে।

পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে সোমবার সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম হেনস্তার শিকার হন। এ ঘটনায় নেপথ্যে নাম আসে জেবুন্নেসার। এরপর থেকে তার বিষয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে তার ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ সম্পদের নানা বিষয় বেরিয়ে আসছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় জেবুন্নেসার নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে বাড়ি-গাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি ও ব্যাংকের অর্থ প্রভৃতি তথ্য বের হতে থাকে। দুদকের কাছেও নানা মাধ্যম থেকে অভিযোগ আসছে বলে জানা যায়।

এতে বলা হয়, জেবুন্নেসার নামে রাজধানীতে চারটি বাড়ি, ফ্ল্যাট, গাজীপুরে ২১ বিঘা জমি, কানাডায় তিনটি বাড়ি, ও লন্ডনে একটি বাড়ি ছাড়াও শত কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। দুদক মনে করছে এসব অভিযোগের সত্যতা যাছাই করা দরকার। প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে অনুসন্ধানে মাঠে নামবে দুদক টিম।

রোজিনার জন্য নাট্যযাত্রা : সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে আটক রেখে নির্যাতন করা ও জেলে পাঠানোর প্রতিবাদ জানিয়ে নাট্যযাত্রার আয়োজন করেছে নাট্য সংগঠন প্রাচ্যনাট। বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় ঢাকায় সচিবালয়ের সামনে থেকে এ নাট্যযাত্রা শুরু হয়। দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে এসে একটি ইম্প্রুভাইজেশন পারফরম্যান্সের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান নাট্যকর্মীরা। করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে আয়োজনটিতে নাট্যকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন।

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন
Website Design and Developed By Engineer BD Network