৯ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার

 

সংস্কারের অভাবে বিলুপ্তপ্রায় নওগাঁর দুবলহাটি রাজবাড়ি

আপডেট: আগস্ট ২১, ২০২০

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন

আমিনুল জুয়েল, নওগাঁ থেকে: রাজবাড়িতে নেই রাজা-রাণী, প্রজা আর পেয়াদাদের চলাচল। নেই রাজসিংহাসন বা রাজার কোন আইন বা শাসন প্রথা।  আর এজন্যই ভঙ্গুর, শীর্ণ সুবিশাল অট্টালিকাটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচ একর এলাকাজুড়ে বিশাল প্রাসাদটি প্রায় দুইশ’ বছরের পুরোনো। কিন্তু সংরক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে ঐতিহাসিক এই রাজবাড়িটি আজ বিলুপ্তির পথে। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অযত্ন ও অবহেলায় এ প্রাসাদটি যেকোনও সময় ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।  জমিদার রাজবাড়িটি নওগাঁ শহর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে দুবলহাটি ইউনিয়নে অবস্থিত।

বর্তমানে এই বিশাল দালানটি মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এছাড়াও নির্দ্বিধায় চলছে অসামাজিক কার্যকলাপ।  ওই অট্টলিকায় কোন দরজা বা জানালার অস্তিত্ব মেলা ভার। এমনকি স্থানীয়রা এখন দালান থেকে ইটও খুলে নিতে শুরু করেছে। দালানটির দ্বিতীয় তলায় ওঠা এখন খুবই ঝূঁকিপূর্ন বিষয়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ইতিমধ্যেই প্রাসাদটির পশ্চিম দিকের একটি অংশ দুবার ভেঙ্গে গেছে। প্রাসাদটির দেখাশুনা করার মত কেউ নেই এখন। ফলে ঐতিহাসিক প্রাসাদটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

    ইতিহাস থেকে জানা গেছে, রাজা কৃষ্ণনাথ ১৭৯৩ সালে এই অঞ্চলটিতে শাসনকার্য শুরু করেন।  তৎকালীন বৃটিশ লর্ড কর্নওয়ালিসের কাছ থেকে ১৪ লাখ ৪ শত ৯৫ টাকায় জায়গাটি কিনেছিলেন তিনি।  তবে কৃষ্ণনাথ ছিলেন একজন নিঃসন্তান রাজা।  তিনি নিঃসন্তান হওয়ায় ১৮৫৩ সালে এই রাজ্যের নতুন রাজা নির্বাচিত হন তাঁর ‍দূরসম্পর্কের নাতি হরনাথ রায়। আর রাজা হরনাথের আমলে দুবলহাটির রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে।

আজকের এই করুণ, ভগ্নদশা রাজবাড়িটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে রাজা হরনাথ এখানে বিভিন্ন নাট্যশালা এবং স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছিলেন। এই অঞ্চলের প্রজাদের খাবার পানির কষ্ট দূর করতে রাজপ্রাসাদের পাশের এলাকায় অনেক পুকুর খনন করেন তিনি।  আর ১৮৬৪ সালে রাজপরিবারের উদ্যোগে একটি স্কুল স্থাপন করা হয়।  পরে স্কুলটির নাম রাজা হরনাথ উচ্চ বিদ্যালয় রাখা হয়। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর রাজা হরনাথ রায় স্বপরিবারে ভারতে চলে যান। মোঘলরা হরনাথ রায় চৌধুরীকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।  তবে তাঁর পূর্ব পুরুষদের জমিদার উপাধি দেন।

দুবলহাট রাজবাড়িতে সাতটি আঙ্গিনা ও তিনশটি কক্ষ ছিল।  প্রাসাদের প্রধান ফটকে (দরজা) রোমান ঘরানার ৪টি পিলার (স্তম্ভ) রাজার রচিশীলতার পরিচয় বহন করে। অট্টলিকার ভিতরের দালানগুলো তিন থেকে চার তলা বিশিষ্ট বলে ধারণা করা হয়।

প্রাসাদের ভিতরে এখনো একটি সান বাঁধানো কূপ রয়েছে। রাজবাড়ির সামনে ছিল গোবিন্দ পুকুর। এই অঞ্চলের লোকজনদের আনন্দ দিতে ওই পুকুরের পাশেই ’গান বাড়ি’ নামক একটি ঐতিহ্যবাহী দালান ছিল। ওই দালানে বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীতসাধনা করা হত।  রাজার গান বাড়ির শেষ সীমান্তে ছিল একটি কালি মন্দির। অবশ্য এখন তা অবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। আর এই কালি মন্দির থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে রাজার বাগান বাড়ির অবস্থান ছিল।

স্থানীয় ঐতিহাসিকদের মতে, দুবলহাটি জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা জগতরাম একজন লবণ ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি তাঁর বাণিজ্য উপলক্ষে দুবলহাটির কাছের গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন এবং বিল অঞ্চলের ইজারা পত্তন গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে তাঁরা প্রচুর জমির মালিক হন। কথিত আছে যে, এই অঞ্চলে তেমন কোন ফসল উৎপন্ন না হওয়ায় ভুমা মহল অজুহাতে দুবলহাটির জমিদার কই মাছ দিয়ে কর পরিশোধ করতেন।  কর হিসেবে প্রতি বছর তাঁদের মাত্র ২২ কাহন কৈ মাছ দিতে হত।

তবে, বর্তমানে রাজবাড়িটির অবস্থা ভীষন করুণ আর দুর্দশাগ্রস্থ।  জমিদারি বিলুপ্তির পর সরকার রাজবাড়িকে সরকারি সম্পদ হিসেবে প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের অধীনে নেয়। প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ দায়িত্ব নিলেও রাজবাড়িটির কোন সংরক্ষণ বা সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের কবলে পড়ে দিন দিন রাজবাড়ির মূল্যবান সম্পদ লুট হয়ে যাচ্ছে।

নওগাঁর সামাজিক সংগঠন একুশে পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুর বারী জানান, সংস্কারের অভাব আর কর্তব্যরত প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রাজবাড়িটি।  সন্ধ্যা নামলেই বসে মদ, জুয়া আর গাঁজার আসর। কেউ দেখার নেই। কারো মাথাব্যথাও নেই।  তবে, ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংস্কার করা হলে একে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র বলেও অভিব্যক্ত প্রকাশ করেন তিনি।

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন
Website Design and Developed By Engineer BD Network