আপডেট: আগস্ট ২৬, ২০২৪
চাকরি জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে গতকাল দিনভর অবরুদ্ধ ছিল প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়। আনসার সদস্যদের আন্দোলনে ছুটির পরও দীর্ঘক্ষণ সচিবালয়ের সবগুলো গেট বন্ধ থাকায় অনেকেই বের হতে পারেননি। চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর প্রেস ক্লাব, হাই কোর্ট ও সচিবালয় এলাকায় বেরিকেড ফেলে পুরো রাস্তা অবরোধ করেন আনসার সদস্যরা। এতে আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। সকাল সাড়ে ১১টার পর থেকে সচিবালয়ের সবগুলো প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় সচিবালয়ের ভিতরে প্রবেশ ও বাহির বন্ধ ছিল। দাবি-দাওয়া নিয়ে আনসার প্রতিনিধিদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ আরও দুই উপদেষ্টার বৈঠকে রেস্ট প্রথা বাতিল করে দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে প্রথমে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন। পরে আবার এক দফা দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এ সময় সড়কে অবস্থান নিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখেন সচিবালয়। এমন পরিস্থিতিতে আজ থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার আশপাশের এলাকায় কোনো প্রকার সভা, সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে গত রাতে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
পরে গতকাল রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে সচিবালয়ের ভিতরে অবরুদ্ধ করে রাখার খবর ছড়িয়ে পড়লে রাত সোয়া ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে একদল শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের সামনে আসে। এ সময় আনসার সদস্যরা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করে। তারা কয়েকজন শিক্ষার্থীকে লাঠিপেটা করে আহত করে। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা পিছু হটে শিক্ষা চত্বরে অবস্থান নেন। অপরদিকে আনসাররা সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর শিক্ষার্থীদের পাল্টা ধাওয়ায় ওই এলাকা থেকে সরে যান আনসার সদস্যরা। উভয় পক্ষের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কয়েকটি সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। খবর পেয়ে রাত পৌনে ১০টার দিকে লাঠিসোঁটা নিয়ে সচিবালয় অভিমুখে রওনা দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অন্তত ৪০ জন আহত হন।
ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, সচিবালয়ের সামনে শিক্ষার্থী ও আনসারদের সংঘর্ষে অন্তত ৪০ জন আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। এদের মধ্যে চার থেকে পাঁচজন আনসার সদস্য, বাকিরা সবাই শিক্ষার্থী। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায়ে পেশাজীবীদের বিভিন্ন পক্ষের আন্দোলনের মধ্যে বুধবার মাঠে নামেন আনসার সদস্যরা। চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে সেদিন থেকেই প্রতিদিন তারা রাস্তায় বিক্ষোভ করছেন। এর অংশ হিসেবে গতকাল সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে সমাবেশ শুরু করেন আনসার সদস্যরা। তাদের সমাবেশের কারণে তোপখানা রোড থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সড়ক বন্ধ করে দেয় পুলিশ। সমাবেশে যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় আসেন আনসার সদস্যরা। একপর্যায়ে তারা ছড়িয়ে পড়েন পুরো এলাকায়। আন্দোলনরত আনসার সদস্যরা কয়েকবার সচিবালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে বিকাল ৩টার দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের সঙ্গে কথা বলে সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দপ্তরে যান। ওই বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, আনসার থেকে ‘রেস্ট প্রথা’ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অন্যান্য দাবিদাওয়া নিয়ে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালকে আহ্বায়ক করে ১০ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটি সব কিছু পর্যালোচনা করে আমাদের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা একটি সিদ্ধান্ত নেব। সচিবালয়ের এই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
আনসারের ডিজি মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ বলেন, নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী আনসার সদস্যরা তিন বছর চাকরি করার পর ছয় মাস রেস্টে থাকেন। আবার ছয় মাস পর অঙ্গীভূত হয়। এই ছয় মাস তাদের জীবন জীবিকা অনেক কষ্টে থাকে। এটা মূল সমস্যা। এই প্রথা বাতিলের ব্যাপারে সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেছি। একটা সুপারিশ প্রণয়ন কমিটি করা হয়েছে। কমিটি সাত দিনের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাবে। সাধারণ আনসারের চারজন প্রতিনিধি কমিটিতে থাকবেন। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা সুপারিশ করব।
বৈষম্যবিরোধী আনসার আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা এপিসি মো. শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তিন বছর পর চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, যাকে বলা হয় রেস্ট। যতদিন জাতীয়করণ না হচ্ছে, ততদিন এই রেস্ট প্রথা বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। এখন আমরা যার যার কর্মস্থলে ফিরে যাব। পরে বিকালে আন্দোলনরত আনসারদের সিদ্ধান্তের কথা জানালে তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং জাতীয়করণ ছাড়া আন্দোলন থেকে সরে যাবেন না বলে জানিয়ে দেন। দাবি না আদায় হওয়া পর্যন্ত সচিবালয় থেকে কাউকে বের হতে দেবেন না এবং কাউকে প্রবেশ করতে দেবেন না বলে ঘোষণা দেন। এতে অফিসের কর্মঘণ্টা শেষ হওয়ায় পর সচিবালয়ের মধ্যে আটকা পড়েন কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অনেক সেবাপ্রার্থী।