আপডেট: জুলাই ২, ২০২০
আপডেট:
মোঃ নূরুজ্জামান মিঞা, ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) থেকে : টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার শরাবাড়ী গ্রামে গৃহবধু সোনিয়া আক্তার মেঘলার রহস্যজনক মৃত্যুতে স্থানীয় মহলে তোলপাড় ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। যৌতুকলোভী সিরাজুলের নির্মম নির্যাতনে মেঘলার মৃত্যু ঘটেছে বলে এলাকাবাসি জানায়। গত ২৬ মে দিবাগত গভীর রাতে গৃহবধু মেঘলার রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
মেঘলা গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া উপজেলার ডুমুরিয়া ইউনিয়নের চর গোপালপুর গ্রামের মৃত আবুল কালামের মেয়ে।
মেঘলার পরিবার ও এলাকাবাসী জানায় , বিগত ২০১২ সালে ঘাটাইল থানার রসুলপুর ইউনিয়নের শরাবাড়ী গ্রামের হুমায়ুন শেখের ছেলে সিরাজুল ইসলামের সাথে মেঘলার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের জন্য মেঘলার উপর শারীরিক ও মানসিক অমানবিক নির্যাতন করতো সিরাজুল। যৌতুকের না টাকা পেয়ে ইস্ত্রি গরম করে ছ্যাকা দিয়ে মেঘলার পিঠ ঝলছে দেয় পাষান্ড ন্বামী। এরকম নির্মম নির্যাতন দেখে মেঘলার পরিবার ২ লাখ টাকা দিয়ে স্থানীয় ধলাপাড়া বাজারে সিরাজুলকে একটি ইলেকট্রিক ও মোবাইল সেন্টারের দোকান করে দেন। তার পরেও স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেয়ে গত ২২ মে গভীর রাতে স্বামীর বাড়ী থেকে পালিয়ে গোপালগঞ্জে পিতার বাড়ী যাওয়ারচেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় মেঘলা। সিরাজুল টের পেয়ে স্থানীয় পেচার আটামোড় থেকে তাকে ধরে এনে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায় মেঘলার উপর।
স্থানীয় সমাজসেবক আব্দুল কুদ্দুছ জানান, হুমায়ুন শেখের ছেলে সিরাজুল খুবই উগ্র ও অর্থলোভী। টাকার জন্য সিরাজুল তার স্ত্রী মেঘলাকে মাঝে মধ্যেই নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করতো। আমরা প্রতিবাদ করলে সে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতো এবং নানা রকম হুমকী দিত। মৃত্যুর ১৫ দিন আগেও মেঘলাকে নির্যাতন শুরু করলে আর্ত-চিৎকার শোনে তার স্ত্রী (আব্দুল কদ্দুছের স্ত্রী) টিনের গেইট ভেঙ্গে বাড়ীতে ঢুকে মেঘলাকে উদ্ধার করে।
এলাকার অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সিরাজুল ভয়ংকর অর্থ ও নারী লোভী। মেঘলা ছাড়াও সিরাজুল মধুপুর থানার আউশনারা ইউনিয়নের মহিষমারা গ্রামের মোবারক হোসেনের কন্যা সাহিদা আক্তার, বাসাইল উপজেলার এলেঙ্গা এলাকার শারমিন, ঘাটাইল থানার রসুলপুর ইউনিয়নের সিংহচালা, সখিপুর থানার বড়চৌওনা ও ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার কেশরগঞ্জ এলাকায় ৭/৮ টি বিয়ে করে। সিরাজুলের স্ত্রী কেউ কেউ নির্যাতন ও অমানবিক অত্যাচারে বাড়ী থেকে পালিয়ে গেছে। আবার যৌতুক না পেয়ে কাউকে সিরাজুল তালাক দিয়েছে। তার বাড়ি সব সময় তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখা হয় যাতে বাইরে থেকে কেউ বাড়িতে প্রবেশ করতে না পারে।
মেঘরার ভাই ইয়াকুব আলী জানান, বিগত ২০১৬ সালে গোপালগঞ্জের আদালতে মেঘলারদায়ের করা যৌতুকের মামলায় সিরাজুল ৩ মাস হাজতবাস করে। পরে ক্ষমা চেয়ে আপোষ মীমাংসা করে পুনরায় মেঘলাকে নিয়ে আসে সিরাজুলের বাড়ীতে। গত ২৬ মে গভীর রাতে মেঘলার মর্মান্তিক রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। মেঘলার এ মৃত্যুকেস্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেনা সচেতন এলাকাবাসী। তাদের মতে যৌতুকের দায়ে চরম নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে গৃহবধু মেঘলাকে।
মেঘলার বড় ভাই ইয়াকুব ও ফরিদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানায়, সিরাজুলের যৌতুকের দাবীর মুখে পর্যায়ক্রমে আমরা প্রায় ৫ লাখ টাকা দিয়েছি। কখনও মোটরবাইক কেনার আবার কখনও বাড়ীর ছাদ নির্মানের অজুহাত তুলে মেঘলাকে বাড়ী থেকে টাকা আনতে বলে সিরাজুল। নিরুপায় হয়ে মেঘলা ধান সিড়ি ট্যাকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার নামে একটি বেসরকারী সংস্থায় চাকুরীর সুবাধে জমানো এক লাখ টাকা দিয়ে দেয় স্বামী সিরাজুলকে। আরো এক লাখ টাকা আনার জন্য মেঘলাকে মারপিট করতে থাকে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে বারবার মেঘলা মোবাইলে বলেছিল ভাই কষ্ট করে হলেও আরো এক লাখ টাকা ম্যানেজ করে দাও। টাকা না পেলে আমার স্বামী আমাকে মেরে ফেলবে, আমি খুব কষ্টে আছি।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা ব্যবস্থা করে দেয়ার চেষ্টা করবো বলে আশ্বস্ত তাকে জানায়। গত ২৬ মে সকালে সিরাজুল আমাদের মোবাইল ফোনে জানায় মেঘলা গুরুতর অসুস্থ্য। এ সময় চিকিৎসার সকল খরচ বহনের আশ্বাস দিয়ে দ্রæত মেঘলাকে সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু সে আমাদের কথা না শুনে স্থানীয়ভাবে লোক দেখানো নামে চিকিৎসা দিয়ে বাড়ীতে ফেলে রাখে মেঘলাকে। অবশেষেযৌতুকের জন্য নির্যাতন আর বিনা চিকিৎসায় অকালে প্রাণ দিতে হলো মেঘলাকে। ক্ষোভের সাথে আরো জানায়,মেঘলা তার লোভী স্বামীর একের পর এক যৌতুকের দাবী পূরণ করতে না পারায় অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। যেভাবেই মেঘলার মৃত্যু হোক না কেন তার জন্য সিরাজুল ও তার পরিবার দায়ী। এ কারণে তাদের কঠোর শাস্তি চাই আমরা। মেঘলার মৃত্যুর পর পরই সুকৌশলে সিরাজুল পালিয়ে যায়। ময়না তদন্তের পরে মেঘলার মরদেহটিও দেখতে আসেনি সিরাজুল ও তার পরিবারের কেউ। অবশেষে আমরা লাশ গ্রহণ করে গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া ডুমুরিয়া ইউনিয়নের চরগোপালপুর নিজ গ্রামে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মেঘলাকেচিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
এ বিষয়ে রসুলপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের মেম্বার মর্জিনাবেগম বলেন, ২৭ মে ভোরে পুলিশের পক্ষ থেকে মোবাইল ফোনে জানতে পেয়ে সিরাজুলের বাড়ীতে যাই। দেখি বিছানার উপর মেঘলার নিথর দেহ পড়ে আছে এবং মুখ দিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত ফেনা বের হচ্ছে। কিভাবে মেঘলার মৃত্যু হয়েছে তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারবো না তবে সিরাজুল যে প্রায়ই তার স্ত্রী মেঘলাকে নির্যাতন করতো সে বিষয়ে আমি শুনেছি। তবে অপরাধী যে হোক তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।
সিরাজুলের পিতা হুমায়ুন শেখকে মেঘলার মৃত্যুর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি আমতা আমতা করে বলেন, পেটের ব্যাথায় মারা গেছে। তাহলে হাসপাতালে ভর্তি করলেন না কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটাই ভুল হয়েছে তবে বাড়ীতে চিকিৎসা করানো হয়েছে।
মেঘলার স্বামী সিরাজুলের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার চেষ্টা করেও তাকে বাড়ীতে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ রয়েছে।
এ বিষয়ে ঘাটাইল থানার এস.আই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান এর সাথে মোবাইল ফোনে মেঘলার মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেঘলার মৃত্যু কি কারণে হয়েছে তা ডাক্তারী পরীক্ষার রিপোর্ট পেলেই জানা যাবে। ভিসেরা রিপোর্টের জন্য নমুনা প্রেরণ করা হয়েছে। ময়না তদন্তেররিপোর্ট পাওয়ার পরেই মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হবে।
এ ব্যাপারে ঘাটাইল থানায় গত ২৭ মে একটি অপমৃত্যুর মামলা রুজু হয়েছে।