১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার

 

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহি অফিসার সোহেল মারুফের হস্তক্ষেপে  রক্ষা পেল খেলার মাঠ; আনন্দের জোয়ার এলাকাবাসীর মধ্যে

আপডেট: জুন ৩০, ২০২০

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন
সাইফুল ইসলাম, কুষ্টিয়া  থেকে:  খেলার প্রধান উদ্দেশ্য আনন্দলাভ হলেও শিশুর বিকাশের জন্য খেলা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাটনি স্মিথ (১৯৭১) বলেছেন, যে চারটি মূল প্রক্রিয়ায় (অনুকরণ, অনুসন্ধান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গঠন) আমরা পৃথিবী সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করি, শিশুর খেলা সেই চারটি প্রক্রিয়া নিয়েই গঠিত।’
আর শিশুদের খেলা-ধুলার জন্য যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে খেলার মাঠ। দিন দিন খেলার মাঠ কমে যাচ্ছে বিভিন্ন কারণে। খেলার মাঠ দখল করে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ ও শিল্পকারখানা তৈরি করা হচ্ছে মফস্বল শহরগুলোতে। কৈশোরে একমাত্র বিনোদনের স্থান হলো খেলার মাঠ। আর এই মাঠগুলো দিন দিন প্রভাবশালীদের দখলে যাচ্ছে, হচ্ছে যৌবনের বিনোদন কেন্দ্র।  নগরায়নের ফলে নাগরিক হচ্ছি ঠিকই, তবে সুনাগরিক হচ্ছি কি-না আমার সন্দেহ আছে। কৈশোর জীবনটি প্রত্যেককেই কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে পার হতে হয়। এ বয়সে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহও থাকে প্রচণ্ড । ফলে আগ্রহ অনুযায়ী ছেলেমেয়েরা খেলার জন্য খেলার মাঠ পাচ্ছে কি-না তা আমাদের সমাজ এবং অভিভাবকদের জানা জরুরি। বর্তমান সমাজে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির প্রধান কারণের মধ্যে খেলার মাঠের স্বল্পতা অন্যতম। এর জন্য সমাজব্যবস্থা ও মফস্বল শহরগুলোর অপরিণত পরিকল্পনাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এই অপরিণত পরিকল্পনায় একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী সুবিধা পেয়ে থাকলেও তা নিকটবর্তী প্রজন্মের জন্য শঙ্কাপূর্ণ। আজ থেকে ১০-১৫ বছর পেছনে তাকালেই একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য ধারণা পাওয়া যাবে।
বিগত বছরগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বসতবাড়ি। ফলে পতিত জমিগুলো আর ফাঁকা পড়ে না থাকায় ছেলেমেয়েরা তাদের নিজ নিজ এলাকার স্কুল কিংবা কলেজের মাঠে খেলাধুলা করতে পারছে না।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার কুচিয়ামোড়া এলাকার একটি  ঐতিহ্যবাহী এবং  খেলার মাঠের নাম হলো বিজেএম কলেজ ফুটবল মাঠ যা স্থানীয়দের কাছে কুচিয়ামোড়া বল ফিল্ড নামে পরিচিত। মাঠটির একপাশে বিজেএম কলেজ ও অন্যপাশে কুচিয়ামোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মাঝের মাঠটি যৌথ মালিকাধীন। জাতীয় দিবস থেকে শুরু করে কলেজ এবং স্কুলের ছেলে-মেয়েরা ছাড়াও এলাকার শিশু-কিশোররা এখানে খেলা-ধুলা করে থাকে।
কিন্ত, সম্প্রতি উক্ত প্রাথমিক বিদ্যায়ের নামে মন্ত্রনালয় থেকে ৪তলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণের জন্য বাজেট আসে; যা এলজিইডি তত্বাবধানে নির্মিত হবে। উক্ত ভবনের জায়গা নির্ধারিত হয় মাঠের মাঝখানে । যা নির্মাণ হলে মাঠটি নষ্ট হয়ে যাবে। বিষয়টিতে টনক নড়েএলাকাবাসীর। বাহাদুরপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সোহেল রানা পবন নেতৃত্বে প্রতিবাদ গড়ে উঠে। তাঁরা বিষয়টি নজরে আনেন ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহি অফিসারের। বিষয়টি আমলে নিয়ে উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা সোহেল মারুফ গত ২৭ মার্চ উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান মিঠুকে নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শনে যান। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা খেলার মাঠটিকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করেন। বাহদুরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসিকুর রহমান ছবি, সাবেক চেয়ারম্যান সোহেল রানার পবন, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যবৃন্দ ও গণমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে উক্ত ভবনটি স্কুলের আঙিনায় মূল মাঠকে রক্ষা করে মাঠের একপাশে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। উপজেলার নির্বাহি কর্মকর্তার দূরদর্শী পদক্ষেপে খেলার মাঠটি রক্ষা হওয়ায়  তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এলাকাবাসী ।
বিজেএম কলেজের প্রভাষক সাইফুজ্জামান ফিরোজ ইউএনওর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, বর্তমান নির্ধারিত আরও ৮/১০ ফুট স্কুলের দিকে সরিয়ে ভবন নির্মাণ হলে মাঠটি আন্তর্জাতিক মাপ বজায় থাকতো।
বিজেএম কলেজের অধ্যক্ষ আসলাম উদ্দীন বলেন, ৪৭ এর দেশ ভাগের পূর্বে এ এলাকার জমিদার অরবিন্দ কুণ্ডু এটি খেলার মাঠ হিসেবে দিয়ে যান। এক সময় এখানে কলকাতার ফুটবল টিম এ মাঠে ফুটবল খেলেছে। এখানকার ছেলেরা কলকাতার মোহন বাগান স্পোর্টিং ক্লাবের সাথে খেলে ট্রপি জেতার ইতিহাস রয়েছে। এছাড়াও একসময় বিভিন্ন সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরকারিলভাবে ফুটবল টিম থাকতো। কুচিয়ামোড়া এ মাঠে ফুটবল খেলেছে ভেড়ামারা পিডিবি, ভেড়ামারা ওয়াপদা, কুষ্টিয়া সুগার মিলস, কুষ্টিয়া মোহিনী মিলস, ঈশ্বরদী আলহাজ্ব মিল, পাকশী পেপার মিল, সিরাজগঞ্জের কওমী জুট মিলসহ বিভিন্ন আন্তঃজেলা প্রতিষ্ঠানের ফুটবল দল। ৮১ সাল পর্যন্ত নিয়মিত টুর্ণামেন্ট হতো। বর্তমানে মাঠটি রক্ষা হওয়ায় ইউএনওকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা সোহেল মারুফে এ প্রতিবেদককে বলেন, শিশুদের শিক্ষার জন্য ভবনের যেমন প্রয়োজন তেমনি মাঠের প্রয়োজনীয়তাও কম নয়। তিনি আরোও বলেন, ‘খোলা জায়গা, খেলার মাঠের অভাবে শৈশব-কৈশোরের স্বভাবজাত খেলাধুলায় মেতে উঠতে পারছে না শিশুরা। এতে কোমলমতি শিশুরা মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। হতাশা, বিষণ্নতা, অবসাদ ও খিটখিটে মেজাজ তাদের সঙ্গী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে অসহিষ্ণু মনোভাব। শিশুর অপূর্ণ মানসিক বিকাশের প্রকাশ নানাভাবে হতে পারে। মানুষ জঙ্গিবাদে জড়াতে পারে। মাদকাসক্ত হতে পারে, সমাজবিরোধী কাজ লিপ্ত হতে পারে।’ শারীরিক ও মানসিক সব ধরনের সুস্থতার জন্য শিশুসহ সব বয়সের মানুষের জন্য মাঠের অবদান বিশাল। কিন্তু আমাদের মাঠগুলো দিনদিন কমে যাচ্ছে।
সোহেল মারুফ বলেন, বর্তমানে মফস্বল শহরের স্কুল কিংবা কলেজের মাঠগুলো রক্ষণাবেক্ষণ অথবা নৈশ শিক্ষা ব্যবস্থা অধিকাংশ জায়গায় চালু হওয়ার ফলে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আর সেই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের বিকেলের সময়গুলো অতিবাহিত করছে। ফলে শারীরিক ও মানসিক দু’ভাবেই তারা বিপর্যয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। খেলার মাঠগুলো ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ার ফলে ছেলেমেয়েরা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। ফলে তাদের আচরণগত পরিবর্তন হচ্ছে। ইচ্ছাকৃতভাবে স্কুল পালাচ্ছে কিংবা সেখানকার নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছে এবং রাষ্ট্রিক আইন বা পৌর বিধিবহির্ভূত কাজ করছে। মাতা-পিতা বা অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ছেলেমেয়েরা পর্নোগ্রাফি বা মাদকে আসক্ত হচ্ছে দিন দিন। কিশোর-কিশোরীদের অধ্যয়ন, সৃজনশীলতা, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করা জরুরি। প্রত্যেকটি স্কুলে মাঠ থাকার পাশাপাশি স্কুলের পরিবেশ হওয়া দরকার আনন্দময় ও প্রণোদনাপূর্ণ। জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হোক আমাদের নতুন প্রজন্ম, এই হোক সবার প্রত্যাশা।
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন
Website Design and Developed By Engineer BD Network