আপডেট: জুন ২০, ২০২০
……...কাশীনাথ মজুমদার পিংকু
♥♥ দুই বুড়া-বুড়ির মধ্যে ভালবাসাটা অন্যদের থেকে একটু বেশীই। একজনের বয়স আশির কাছাকাছি। অন্যজনের সত্তরের উপরে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্বামী-স্ত্রী’র ভালবাসাও না-কি বাড়তে থাকে। মজুমদার দম্পতির ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। দু’জনেই অবসরপ্রাপ্ত হাইস্কুল শিক্ষক । ভালবাসাটা গাঢ় হয়েছে তাদের অবসরের পর থেকেই। একজন আরেকজনকে এক মুহূর্তের জন্যও না দেখে থাকতে পারে না। আবার একসাথে থাকলেও একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের হাজারো অভিযোগ। তবে কেউই সেটা স্বীকার করে না। যদিও বিষয়টা নিয়ে ছেলে-মেয়ে, বৌমা-মেয়ের জামাই আর নাতিনদের কৌতুহলের শেষ নেই। শুধু ভালবাসা না, দিনের প্রতিটি প্রহরে তাদের মধ্যে দু’চারবার করে ঝগড়াও হয়। ঝগড়ার বিষয় খুবই মামুলি। একজন রাতে ফ্যান দিয়ে ঘুমাবে তো অন্যজনের না। একজন টিভি-তে নিউজ চ্যানেল দেখবো তো আরেকজন নাটকের চ্যানেল। দু’জনেই কানে কম শুনলেও একজন আরেকজনকে কানে কম শোনার অভিযোগ করে। একজন বাসার একরুমে গান করতে বসলে আরেকজন অন্যরুমে বসে সেই গানের ভুল ধরে। ঔষধ খেতে মাসে কার বেশী টাকা খরচ হয় সেটা হিসেব নিকেশ করা। ইত্যাদি ইত্যাদি।আর প্রতিবার ঝগড়ার ক্ষেত্রে বিচারক তাদের একমাত্র ছেলের বউ। মাঝে মাঝে মেয়ে এসেও বিচারকের ভূমিকা পালন করে যায়। তবে ছেলের সামনে তাদের দু’জনের ঝগড়াটা একটু কম হয়। এক্ষেত্রে তারা আবার একটু বেশী সচেতন। কারণ ছেলে তাদের এইসব টুকটাক ব্যাপারে খুব বেশী পাত্তা দেয় না। আর নয় বছর বয়সী একমাত্র নাতিন ঠাম্মা- দাদনের ঝগড়ার সময় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। কারও পক্ষে রায় দিতেও সে তখন বিব্রত বোধ করে।
একদিন হটাৎ করেই মিসেস মজুমদারের মনে হলো স্বামীকে জাত করার জন্য একটা কিছু করা দরকার। তাদের মেয়ের জামাই-ও গ্রামের বাড়িতে গেছে। আসতে দু’একদিন দেরী হবে। মেয়েকে এত বড় ফ্ল্যাটে একা থাকতে হবে। সেই অজুহাতেই একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান খাওয়া শেষ করে মিসেস মজুমদার চলে গেলো তার মেয়ের বাসায়। যাওয়ার সময়ও বাসার প্রত্যেককে আলাদা করে ডেকে ডেকে যাওয়ার কথা বললো সে। না, ছেলে-বৌমা-নাতিন কারও কোন আপত্তি নেই। মিসেস মজুমদার হয়তো মনে মনে চাইছিলো কেউ একজন তাকে ‘না’ বলুক। কিন্তু তার সে ক্ষীণ আশাও যেন সমুদ্রের জলে পরে লবনের মতই বিলীন গেল। কী আর করা? হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল সে। মেয়ের বাসা একই এলাকার পরের গলিতেই। চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে মেয়ের বাসা থেকে ফোন করে পৌছাসংবাদও জানালো। তখনই নাতিনের কাছে একবার খবর নিলো-‘ দাদন কী করে? বাড়ির সবাই কী করে?’ ইত্যাদি বলে। ঠাম্মা-নাতিনের ফোনালাপ শুনে ছেলে আর ছেলের বউ মনে মনে তখন হাসছে। মজা পাচ্ছে নাতিনও। তবে তারা কেউই মি. মজুমদারের কাছে কিছু বলছে না। মজুমদারেরও উৎকন্ঠার শেষ নেই। তার বউ ঠিক মত পৌছালো কি-না। শাশুড়িমা যে সেদিন আর বাড়িতে আসবে না, একথা নিশ্চিত জেনেও দুপুরে খাওয়ার আগে ছেলের বউ একবার ফোনও করলো । তখনও একই খবর জানতে চাইলো শাশুড়ি। তার স্বামীর স্নান-খাওয়া হয়েছে কি-না। দুপুরে কী কী দিয়ে ভাত খেয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সুযোগ পেলেই মি. মজুমদার নাতিনকে ফোন করে তার ঠাম্মার খোঁজ খবর নিতে বলে। সন্ধ্যার আগে আরও একবার নাতিনকে ফোন করলো তার ঠাম্মা। ফোনের মূল কথা হচ্ছে- তার মেয়ে তাকে কিছুতেই আসতে দিতে চাইছে না। রাতে থাকলে কোন অসুবিধা হবে কি-না। বাবা-মা’র শিখানো কথা মত নাতিনও তাকে রাতে থেকে আসতে বললো। রাতে মেয়ের বাসায় থেকেও গেলো মিসেস মজুমদার। কিন্তু এই খবর যেন মি. মজুমদারের কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাত। না পারছে কাউকে কিছু বলতে,না পারছে সইতে। রাতে আরও বেশ কয়েকবার দফায় দফায় ফোনে খোঁজ খবর নেওয়া। দূরে থাকলে ভালবাসা যে আরও গভীর হয়- সেটা মি. মজুমদারের রাতে ভাল ঘুম না হওয়াতেই বুঝে গেলো তার ছেলে আর বৌমা। পরের দিন ভোর না হতেই আবার ফোনে স্বামীর খবর নিলো মিসেস মজুমদার। এভাবে পরেরদিনও মাঝ রাত পর্যন্ত দফায় দফায় চললো ফোন পর্ব। প্রতিবারই বিষয়বস্তু ঐ একই। সেদিনও ফিরলো না মিসেস মজুমদার।
মি. মজুমদার ফোন না করলেও মন খারাপ করে এক রুম থেকে আরেক রুমে বসে থাকে, টিভি দেখে, বারান্দা দিয়ে হেঁটে বেড়ায় । নাতিন গিয়ে বললেও মন খারাপের কথা সে কিছুতেই স্বীকার করে না। দ্বিতীয় দিন ভোর না হতেই আবার ছেলের কাছে মায়ের ফোন। ছেলের বাবার কথা কিছু না বললেও নাতিন তার কথা কিছু বলে কী-না, নাতিনের জন্য তার মন অনেক খারাপ, নাতিনকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, আজ একবার এসে কিছুক্ষণ থেকে আবারও চলে যাবে সে- ইত্যাদি ইত্যাদি। ছেলে তার মায়ের ফোনের সারমর্ম স্ত্রীর সাথে শেয়ার করতেই এবার শাশুড়িকে তার বউমা’র ফোন- ‘ দিদিকে নিয়ে চলে আসেন। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে আবার না হয় সন্ধ্যায় চলে যাবেন।’ শাশুড়ি যেন এই ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলো। বৌমা’র এই কথা শুনে শ^শুড়মশাই মহা খুশী। তার মনের কথাই যেন বলেছে বৌমা। এদিকে বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে । সেই দুঃশ্চিন্তাও আাছে শ^শুড়ের মনে। বৃষ্টির কারণে যদি আবার সিদ্ধান্ত পাল্টায়। না, দুপুরের খাবারের আগেই বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে মিসেস মজুমদার তার মেয়েকে নিয়ে এসে হাজির। বাড়ির সবাই তখন মনে মনে খুবই খুশী আর সবার খুশীর বহিঃপ্রকাশটা প্রকাশ পেলো নাতনির আনন্দের মধ্য দিয়ে। তাদের বাসায় তখন ঈদ ঈদ ভাব। ♥♥
নেক্সটনিউজ/জে.আলম