আপডেট: মে ২৯, ২০২০
…….কাশিনাথ মজুমদার পিংকু
‘এই সময়ে যে ক’জন কথাশিল্পীর অমেয় সৃজন প্রতিভায় বাংলাদেশের ছোটগল্প ঋগ্ধ ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে রোকেয়া ইসলাম তাদের অন্যতম ‘- বাক্যটি পলল প্রকাশনীর প্রকাশক ” একবার ডাক সমুদ্র বলে—” গল্পগ্রন্থের মুখবন্ধে বলেছেন কথাশিল্পী রোকেয়া ইসলাম সম্পর্কে। কবি রোকেয়া ইসলাম, নাট্যকার রোকেয়া ইসলাম, শিক্ষক রোকেয়া ইসলাম, সংগঠক রোকেয়া ইসলাম সব পরিচয় ছাপিয়ে রোকেয়া ইসলাম আমার ভাবী-অাপা। কেন অামার কাছে তিনি ভাবী-আপা সেই গল্প এই গল্পগ্রন্থের পাঠ প্রতিক্রিয়ায় প্রাসঙ্গিক নয় বলেই বলছি না। সময় সুযোগ হলে অন্য কোথাও বলা যাবে একদিন। একজন স্নেহপরায়ন রোকেয়া ইসলামের কাছে অামি দেবর-ভাই বলেই হয়তো তার মত একজন উঁচুমানের লেখকের গল্পগ্রন্থ নিয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশের দুঃসাহস দেখাচ্ছি।
যে যাই হোক, ” একবার ডাক সমুদ্র বলে—-” গল্পগ্রন্থটি ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হলেও আমার পড়ার সৌভাগ্য হলো করনাকালে। তাও আবার শ্রদ্ধেয় কবি মাহমুদ কামাল স্যারের সৌজন্যে যার নামে লেখক এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন।গ্রন্থে মোট গল্পের সংখ্যা সাতটি যায় প্রত্যেকটি গল্পই সমকালিন। প্রতিটি গল্পের শরীর বিনির্মানেই রয়েছে আলাদা আলাদা এক নির্মানশৈলী। গল্পকথনেও তিনি স্বতন্ত্র। সহজ, সরল ও সাবলিল ভাষায় তুলে এনেছেন সমাজের চারপাশে ঘটে যাওয়া দ্বন্দ্ব- সংঘাত, প্রেম- ভালবাসা, মানুষের আবেগ ও ছোট ছোট অনুভূতিগুলিকে। প্রতিটি গল্পের প্রতিটি অনুচ্ছেদেই রয়েছে আলাদা এক অাবেদন যা একজন পাঠককে নিমিষেই গল্পের শেষ বিন্দুতে নিয়ে যায়। কিন্তু ছোটগল্প যে শেষ বিন্দুতে পৌছালেই শেষ হয় না তা রোকেয়া ইসলামের গল্পে অাবারও প্রমানিত। রোকেয়া ইসলাম তার গল্পের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রেখে যান নানা প্রশ্ন। যে প্রশ্নগুলি পাঠককে নিয়ে যায় আলাদা এক ভাবনার জগতে।আর তার গল্পে থেকে যায় কিছু না বলা কথা।
গ্রন্থের প্রথম গল্প “অগ্নিস্পর্শ”-এ লেখক তৎকালিন সমাজ ব্যবস্থায় জমিদারদের চরিত্রের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন যা বর্তমান প্রজন্মের কাছে ঘৃণা অার অপরাধের। গল্পের শেষটা খুব সহজেই পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করে যায়। “আদুরী” গল্পে আমাদের বর্তমান সমাজের হাজারো অাদুরীর করুন চিত্র ফুটে উঠেছে যারা ক্ষুধা অার দারিদ্রতার কাছে পরাজিত হয় বারবার। বিসর্জন দিয়ে হয় আদুরীদের সর্বস্ব। “মুঠোফোন ” গল্পের বক্তব্য এক অসহায় নারীকে নিয়ে যার ভালোবাসা আর স্মামীর প্রতি অন্ধ বিশ্বাস তাকে নিয়ে যায় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। “ডাঙ্গায় মাছ সাঁতার” গল্পে সমাজের বিকৃত রুচিসম্পন্ন কিছু পুরুষের সমকামিতার ঘৃণ মানসিকতার চরিত্রকে বর্ননা করা হয়েছে। ” হারজিত” নামক গল্পটি তো আমাদের অভিজাত সমাজ ব্যবস্থার কোপানলে একজন অতি সাধারণ নারী কি করে প্রতিবাদী হয়ে উঠে, হয়ে উঠে মক্ষীরানী সেই চিরাচরিত গল্পের বাস্তব প্রতিফলন। গ্রন্থের পরের গল্পের নাম “সন্ধ্যালোকে উড়ে যায় ঝরাপাতা”। এই গল্পে রোকেয়া ইসলাম একজন সহজ সরল অথচ প্রতিবাদী নারীর বলিষ্ট চরিত্রের মাধ্যমে অামাদের তথাকথিত লোভী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মুখে স্বজোড়ে চপটাঘাত করেছেন। আর গ্রন্থের শেষ গল্প ” একবার ডাক সমুদ্র বলে—–” গল্পে অামরা বাস্তববাদী রোকেয়া ইসলামকে অাবিষ্কার করি রোমান্টিক লেখক রোকেয়া ইসলামকে। গল্পের পরতে পরতে ভালোবাসার যে অপ্রাপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে শেষ পর্যন্তও সেই ভালবাসার আবেদন রেখে গেছেন লেখক। ভালোবাসার প্রকৃত সুখ কী না পাওয়ার বেদনায় না-কি পেয়ে হারানোর বেদনায়? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য পাঠককে গল্পের অারও অনেক গভীরে যেতে হবে। যে যোগ্যতা অন্তত অামার নেই। তবে একজন অতি সাধারণ পাঠক হিসেবে এইটুকু বলবো গল্পের প্রুফ দেখার সময় প্রকাশক অারও সচেতন হলে ভালো হতো। কথাশিল্পী রোকেয়া ইসলাম তার নিজ গুনেই অাধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তার অবস্থানকে সুদৃঢ় করবেন এটা আমার আশা নয়, বিশ্বাস। পরবর্তী কোন গল্পগ্রন্থ পড়ার প্রতীক্ষায় শেষ করছি। জয় হোক কথাশিল্পী রোকেয়া ইসলামের।
লেখক : কাশীনাথ মজুমদার পিংকু
শিক্ষা- সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী
এলেঙ্গা- টাঙ্গাইল।